
এ জীবনটা কেন বাস্ক বন্দী হয়?

সেলিনা মোমেন
প্রকাশ ২০২২-০৯-২৯ ১২:৪২:৫৫

গত কয়েকটা দিন ধরে আমরা দেশের বাইরে আছি । কিন্তু একটা বিষয় গভীরভাবে মনে হচ্ছে,যার জন্ম পৃথিবীতে সকল মানুষের মধ্য সেরা জন্ম বলে মনে হয়, যার শাসনের অধীনে ছিল পৃথিবীর অধের্কের বেশী দেশ, তাঁর হুকুমে বাঘে গরু এক ঘাটে পানি খেয়েছে । তাঁর দাপটে বলতে গেলে সবাই মাথা নত করেছে ।যখন যা ইচ্ছা হয়েছে, তার ইশারায় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে বা পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছেন, এসব ছিল ক্ষমতা রক্ষা বা তাঁর বংশের মুখ রক্ষার জন্য।
তিনি জীবনে সেরা জিনিষটা খেয়েছেন বা পরিধান করেছেন। এক কথায় বলতে গেলে, তিনি সুখী মানুষই ছিলেন। জীবনটাকে উপভোগ করেছেন।
কিন্তু তাঁকে যখন এ পৃথিবী চলে যেতে হবে , সেটাও তিনি সুন্দর করে পরিকল্পনা করে গেছেন । তাঁর বাস্কটার বাইরের ডিজাইন ও উনি কোথা থেকে শেষ যাত্রা করবেন সেটা ও উনি ঠিক করে গেছেন ।ওনার কথা মত সব কিছুই সে ভাবে হয়েছে।তবে সত্য বিষয় হলো, তাঁকেও বাস্ক বন্দী হতে হয়েছে।তাকেও এ পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়েছে।এতো সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অবাক হওয়ার মতই।
উনার শেষ কৃত্য হলো, আমরা তখন লন্ডনে বসে টিভিতে দেখছি আর ভাবছি, এও কি সম্ভব! হাজার হাজার মানুষ ১০ দিন ধরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে- বসে থেকে সেই বাস্কটাকে একটি বার সন্মান জানানো- এর চেয়ে আর কিছু নয় ।তারপর যার যার স্থানে চলে গেলো ।বলা বাহুল্য, এটাতে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও উনার বোন শেখ রেহানা যোগ দিয়েছিলেন। সেটা হলো রাণী এলিজাবেথের শেষ কৃত্য অনুষ্ঠান।
আর আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিল জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে থাকতে।
যে মানুষটির জীবনে হা ছাড়া না ছিল না, তাঁর জীবনে সব সফলতা ছিল ,তা না হলে প্রায় নয় বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতেন না! এতো কর্মের মধ্যে ও তাঁকে অপঘাতে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে হলো।
মৃত্যু তো হবেই- এটা অবধারিত। কিন্তু কিছু মৃত্যু যে মনে রাখার মতো, তাঁর শেষ যাত্রা যে এতো সুন্দরভাবে সম্পূর্ণ হবে, তা দেখার মতো বা সবাইকে জানানোর মতো। যা দেখে আজ আমি লিখতে বসলাম।
কি সুন্দর আর কত সুশৃঙ্খলভাবে তাঁদের শেষকৃত্যের সমাপন হলো, তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার জন্য কিছুটা দুরহ ।শুধু বলবো, মানব জাতি চাইলে কি না পারে?
শিনজে আবের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আমাদের সবাইকে আরেকটি হোটেলে নেওয়া হলো। দেখলাম কয়েক শত মানুষ এ হোটেলে আছেন। এ ভাবে বেশ কিছু হোটেল থেকে আরো সবাইকে নিয়ে বাসে করে আবের সমাধি সৌধে নিয়ে যাওয়া হলো । সবাইকে নেওয়া হলো বাসে করে। আমরা ছিলাম ২্নম্বর বাসে। আমরা সকলে শৃঙ্খলার সাথে সারিবদ্ধ হয়ে একে একে যার যার দেশের নাম লেখা আছে, সেখানে গিয়ে বসলাম । আমাদের পাশে ছিলেন মেক্সিকোর অ্যাম্বাসেডর Ms. Melba Pría. উনি এখন জাপানে আছেন, আগে আমাদের দেশে ছিলেন।
শিনজে আবে সবচেয়ে সফল প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, প্রায় নয় বছর অত্যন্ত সফলতার সাথে দায়িত্বপালন করেছেন। তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে এসে একটা জিনিষ দেখলাম, হাজার হাজার মানুষ, কিন্তু সবাই যে কত সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছে। তাদের এই নিয়মানুবর্তিতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি ভাবছি, আমরা কোথায় আছি, কোন পৃথিবীতে বাস করি।
যাই হোক যেটা বলছিলাম ,আমাদেরকে হোটেল থেকে অন্য একটা হোটেলে নিয়ে আসলো। এখানে এসে দেখলাম আরো অনেক দেশের মানুষ এসেছে। এরকম আরো অনেক হোটেল থেকে লোকজন নিয়ে আমাদের বাসে করে শেষকৃত্যের জায়গায় নিয়ে গেল ।সেটা ছিল একটা স্টেডিয়াম ।একটা সাইডে আবের বড় করে ছবি টাঙ্গানো, অন্য দুসাইডে টিভিতে ভিডিও ডকুমেন্টারি দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর কয়েকটা দেশের রাষ্ট্র প্রধান ও আবের বৌ ও পরিবারের সদস্যরা আসলেন । শিনজে আবের বৌ সারাক্ষণ কাঁদছিলেন দেখছিলাম ।শুনেছি ওদের দুজনের প্রতিদিনের ভালবাসার কথা একটা টিভি তে প্রচার হতো, ওদের সার্বিক জীবনের ভালবাসার কথা। একজন নিয়ে আসলেন একটা বাস্ক, তাতে রয়েছেন জাপানের সমস্ত জীবনের গৌরব অর্জিত সফল প্রধানমন্ত্রী শিনজে আবে। এই বাক্স থেকে কেউ আর আবে কে মুক্ত করতে পারবে না।
আবের জীবনের সব সফলতা ও শিক্ষা রেখে গেছেন আগামী প্রজন্মের জন্য, জাপানের মানুষ সারা জীবন তাঁর কথা স্মরণ করবেন বলে আমার মনে হয়।সেই আবের দেহাবশেষ পোড়ানো ছাইয়ের বাস্কটা সামনে রাখা আছে।
সেটাকে ১৯ বার গানস্যালুট দিয়ে গার্ড রেজিমেন্ট বাস্কটাকে রেখে গেলেন সবার সন্মান জানানোর জন্য ।সেখানে একের পরে রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে পরিবারবর্গসহ সবাই ফুল দিয়ে সন্মান জানানোর পর বর্হিঃবিশ্বের একে একে সকলের ডাক আসলো ।এক সময় আমাদেরও ডাক এলো।
আমরাও সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে গেলাম । যাওয়ার সময় আবের বৌকে সম্মান দেখিয়ে ফুল দিতে গেলাম । তখন মনের ভেতরে কেন জানি একটু কষ্ট অনুভব করলাম ।মনে হলো, এ জীবন কিসের? কেন এ আসা যাওয়া ? তারপরই মনে হলো ভাল কাজের কৃতিত্ব এটা ।আমরা ফুল দিয়ে সবার সাথে বের হয়ে গেলাম।
আবার সে দু নাম্বার বাস ধরে চলে আসলাম হোটেলে। ওখান থেকে গাড়ীতে করে নিজেদের হোটেলে চলে আসলাম । আসার পথে দেখলাম হাজার হাজার মানুষ সারিবদ্ধ হয়ে সবাই সম্মান জানানোর জন্য এগিয়ে যাচ্ছে । সবচেয়ে ভালো লাগার দিকটা ছিল, কোন চিৎকার চেচামেচি নাই । কোন হট্রগোল নাই। মনে হচ্ছে , স্রোতের ধারায় এগিয়ে চলেছে সবাই।
এ যে চুপ করে থাকা বা কথা বললেও নিচু স্বরে কথা বলা কেমন করে শিখেছে, সেটা জানতে ইচ্ছা করে।
কেহ তো জন্মগতভাবে কিছু শিখে আসে নাই , তাহলে তারা পারে আমরা পারি না কেন ? কেন আমরা দুজন বা তিনজন মানুষ হলে চিৎকার ছাড়া কথা বলতে পারি না।আমাদের এখনও অনেক কিছু শেখার আছে মনে হয়।
ছোট বেলায় সকালে যখন আরবী পড়তে যেতাম হুজুরের কাছে, হুজুর বলতেন জোরে জোরে পড়তে । মাষ্টারের কাছে গেলেও জোরে জোরে পড়তে বলতেন। জোরে না হলে হুজুরে পিটাতো, মাষ্টারে বকা দিত (অবশ্য মাষ্টার বাড়ীতে লজিং থাকতো )। এ বয়সে এসেও আমরা পাল্টাতে পারি নাই কেন?
এখন আমরা মনে হয় অনেক বেশী স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি বা হয়ে গেছি । তারপরও বলবো, আমাদের গ্রামের মানুষগুলি এখনও ভাল ও সরল মনের আছে ।এখনও যান্তিক হয়ে যায় নাই । আমারা সভ্যতার কোন জায়গায় আছি , তা এখন বলতে পারছি না বা বুঝতে পারছি না । তার পরেও বলবো আমরা মানুষ বলে বেঁচে আছি।
লেখক সেলিনা মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সহধর্মিণী, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও মোমেন ফান্ডেশনের চেয়ারপার্সন।
সিলেট প্রতিদিন/ এমএ

বিজ্ঞাপন স্থান
পুরাতন সংবাদ খুঁজেন
বিজ্ঞাপন স্থান
ফেসবুক মন্তব্য