ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ।আর এই জগত নিয়ন্ত্রণ করছে নতুন এবং পুরাতন অপরাধীরা। তাছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। এদের খপ্পরে পড়ে অনেকের প্রানহানি থেকে শুরু করে নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনলাইন ব্যবহারকারী ও সাধারণ মানুষ। এই অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে তরুণরা। আর ভুক্তভোগীর মধ্যেও তরুণ-তরুণীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাইবার জগতে অন্তত সাত ধরনের অপরাধী চক্র বেশি বেপরোয়া। এরমধ্যে অপহরণকারী চক্র, হানি ট্র্যাপ গ্যাং, জঙ্গি, প্রতারক, স্ক্রেমিং, বুলিং ও হ্যাকার চক্র অন্যতম। এদের খপ্পরে পড়ে কেউ জড়াচ্ছেন উগ্রবাদে, কেউ হারাচ্ছেন সর্বস্ব, আর কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ।
২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর চালু হওয়া পুলিশের ‘সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ উইংয়ের তথ্যমতে, শুরু থেকে ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ উইংয়ে ৩১ হাজার ১৭৮টি অভিযোগ এসেছে। ফেক আইডি, আইডি হ্যাক, ব্ল্যাকমেইলিং, মোবাইলে হয়রানি, আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানো এবং অন্যান্য বিষয়ে এসব অভিযোগ এসেছে।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে সাইবার অপরাধের মধ্যে অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার হার ছিল ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশে। অনলাইনে এসএমএস পাঠিয়ে হুমকির হার ছিল ২০১৮ সালে ১৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে এ হার দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশে। ২০১৮ সালে পর্নোগ্রাফি ব্যবহার করে হয়রানির হার ছিল ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০২৩ এ হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১২ শতাংশে। তবে এসব অপরাধের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন অপরাধ। সম্প্রতি এই অপরাধী চক্র আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
অপহরণকারীদের একেকটি চক্রে একাধিক তরুণীও কাজ করেন। তারা টার্গেট ব্যক্তিকে সম্পর্কের টোপে ফেলে ডেকে নিয়ে যান। এরপর কোনো বাসায় আটকে আপত্তিকর ভিডিও তুলে জিম্মি করা হয়। এসব ভিডিও স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। সম্প্রতি সিলেটের জকিগঞ্জ এলাকা থেকে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তি ঢাকার মিরপুর ২ নম্বর এলাকা থেকে এবং রামপুরা এলাকা থেকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে,সিলেটসহ সারাদেশে অন্তত ৫০টি অপহরণ চক্র সক্রিয় রয়েছে এর মধ্যে,কালা জাহাঙ্গীর, নাহিদ, সাইফুল, বিকাশ, মারুফ আহমদ, জামাল উদ্দিন ও রকি খানের সিন্ডিকেট সবচেয়ে বেশী বেপরোয়া। সিলেটসহ সারা দেশে রয়ছে তাদের শক্তিশালী অপরাধ নেটওয়ার্ক। তাদের খপ্পরে পড়ে ইতিমধ্যে অনেকেই নিঃস্ব হয়েছেন। অনেক উদিয়মান তরুণ তাদের ভয়ে ব্যবসা, চাকরি হারিয়ে দেশান্তরি।
এই চক্রটি দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন সাইবার বিশেষজ্ঞদের টার্গেট করে প্রথমে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে তাদের কথামত কাজ করাতে চায়। রাজি না হলে মধ্যযুগীয় বর্বরতাও তাদের কাছে হারমানায়। সম্প্রতি এই চক্রটি আবারও সক্রিও হয়ে উঠেছে। গত ৪ আগস্ট সিলেটের বিডি আইটি সলিউশনের কম্পিউটার ইন্জিনিয়ার ফয়ছল আহমদেকে অপহরণ করে ওই চক্রটি। সিসিটিভি ফুটেজের সুত্র ধরে ৪ দিন পরে খুলনা থেকে ফয়ছল আহমদেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।
এছাড়াও তারা সুন্দরী তরুণীদের দিয়ে ভিডিও কলের মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ পাতে। অচেনা নম্বর থেকে কারও মোবাইলে আসা ভিডিও কল রিসিভ করতেই ভেসে ওঠে নগ্ন তরুণীর ভিডিও। অপর পাশ থেকে স্ক্রিনরেকর্ড করে ১০-২০ সেকেন্ডের মধ্যেই কলটি কেটে দেওয়া হয়। এরপর ভিডিও এডিট করে অর্থ দাবি করে হুমকি দেওয়া হয়। দাবির টাকা না দিলে আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।
মান-সম্মানের ভয়ে অনেকেই নীরবে অর্থকড়ি দিয়ে দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থও হন না। আবার কখনো গ্যাংয়ের তরুণীরা অনলাইন চ্যাটিংয়ে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এমনকি সাধারণ মানুষকেও একই কায়দায় ফাঁদে ফেলে।
সূত্র জানিয়েছে, হানি ট্র্যাপ গ্যাং মূলত তাদের অনুগত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে পরিচালনা করা হয়।
ওই সুত্র জানায়, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড স্কিমিংয়ের মাধ্যমেও অর্থকড়ি হাতিয়ে নিচ্ছে অপরাধ চক্র। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ক্রিমার যন্ত্রের মাধ্যমে কার্ড স্কিমিং করা হয়। তথ্য চুরি করে সেই তথ্য দিয়ে কৌশলে টার্গেট ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট খালি করে দেওয়া হয়।
এছাড়াও বিভিন্ন ওয়েবসাইট, কম্পিউটার হ্যাক করা হয়। সামাজিক মাধ্যমে আইডি, ইমেইল, অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে টাকা দাবি করে হ্যাকাররা। এছাড়া ডিজিটাল লেনদেন মাধ্যম বিকাশ হ্যাক করেও টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। প্রবাসীদের ইমু আইডি হ্যাক করে একটি চক্র নানা কৌশলে তাদের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে।
সাইবার বিশ্লেষকরা বলছেন, সাইবার অপরাধীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তাছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ার কারনে এই চক্রটি আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।তারা ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে,অপহরন,চাঁদাবাজি ও প্রতারণা করে থাকে।অপরাধী চক্রের খপ্পর থেকে মুক্ত থাকতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর হওয়ার পরামর্শ নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের।