পরিবারের স্বপ্নপূরণের আশায় ইউরোপের পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন রাজা হোসেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হলো না। গ্রিসে সহকর্মীদের হাতে খুন হয়েছেন রাজা; এমন অভিযোগ করেছেন তার মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজন।
নিহত রাজা হোসেন (২৮) সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের রনসী গ্রামের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা। আট ভাইবোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় এবং চার ভাইয়ের মধ্যে ছিলেন বড়। তার বাবা আবদুল জলিল ছিলেন ওমানপ্রবাসী। ২০১৯ সালে দেশে ফিরে এসে জমি বর্গাচাষ করে কোনোভাবে সংসার চালান তিনি।
রাজার পরিবার জানায়, ধারদেনা করে প্রায় ২০ লাখ টাকা খরচ করে বছর দেড়েক আগে ছেলেকে ইউরোপের দেশে পাঠান জলিল। ওমান, ইরান ও তুরস্ক হয়ে রাজা গ্রিসে পৌঁছান। পথে একবার মানবপাচারকারী চক্রের হাতে বন্দি হয়ে মুক্তিপণের জন্য দিতে হয় সাড়ে ১২ লাখ টাকা। পরে ধাপে ধাপে আরও খরচ হয় প্রায় ৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে খরচ হয় প্রায় ২১ লাখ টাকা। ফেরত আসে মাত্র ২ লাখ। এখনো প্রায় ১৯ লাখ টাকা ঋণের বোঝা টানছেন পরিবার।
রাজা গ্রিসে কাজ করতেন শান্তিগঞ্জ উপজেলার পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের সলফ গ্রামের সেবুল মিয়ার অধীনে। সেবুল দেশে আসার সময় রাজাকে ফোরম্যানের দায়িত্ব দিয়ে যান। এতে ক্ষুব্ধ হন সলফ গ্রামের ইব্রাহিম আলীর ছেলে রফিক আহমদ, মৃত মনাফের ছেলে সেজুল হোসেন এবং হবিগঞ্জ জেলার রেজাউল করিম, জামাল হোসেন ও রাহুল।
২৫ জুলাই মোটরসাইকেলযোগে কাজে যাওয়ার সময় একটি নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে মোটরসাইকেলের উপরে বসে দেশে থাকা এক নারী আত্মীয়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছিলেন রাজা। তখন তার সামনে রফিকও ছিলেন। ঠিক তখন পেছন থেকে তাকে আঘাত করে গ্রিসে কর্মরত একই এলাকার কয়েকজন। পুরো ঘটনাটি ভিডিও কলে থাকা নারী দেখেছেন। ঘটনার ৩ দিন পর পরিত্যক্ত স্থানে একটি টিন দিয়ে ঢাকা অবস্থায় রাজা হোসেনের লাশ পাওয়া যায়।
রাজার এমন মৃত্যুর খবরে শোকে স্তব্ধ তার পরিবারসহ পুরো রনসী গ্রাম। এক সম্ভাবনাময় তরুণের মৃত্যু যেন থমকে দিয়েছে অনেকগুলো জীবনের স্বপ্ন।
সন্তান হারানো মা নিবারুন নেছা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সবাই আসে, আমার রাজা আসে না কেন? প্রতিদিন ফোন দিত। সাত দিন হয়ে গেল আমার ছেলে কোনো খোঁজ নেয় না। আমি বিচার চাই।
বাবা আবদুল জলিল বলেন, আমার ছেলে আমাদের পরিবারের সর্বেসর্বা ছিল। তাকে ঋণ করে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম। স্বপ্ন ছিল ঋণমুক্ত হয়ে বাড়ি বানাবে, ভাইবোনদের লেখাপড়া চালাবে। কিন্তু এখন আমার সব শেষ। আমি তার খুনিদের ফাঁসি চাই। সরকারের কাছে অনুরোধ, যেন আমার ছেলের লাশ দ্রুত দেশে আনা হয়। অন্তত শেষবারের মতো তাকে দেখতে চাই।
রাজা হোসেনের আত্মীয় ও গ্রামের সালিস ব্যক্তিত্ব লুৎফর রহমান বলেন, ‘রাজা ছিল পরিশ্রমী ও স্বপ্নবান ছেলে। ভাইবোনদের পড়াশোনার খরচ চালানো, বোনদের বিয়ে দেওয়া, আর বাবার ঋণ শোধ এই ছিল তার চিন্তা। তার কোনো শত্রু ছিল না। সবাইকে নিয়ে চলত। কাজের ক্ষেত্রে ফোরম্যান হওয়ায় কয়েকজন ঈর্ষান্বিত হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আমরা শুনেছি। আমরা এই হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই।’
অভিযুক্ত রফিক আহমদের চাচা কাজি আইয়ুব আলী বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত না যে রফিক জড়িত কি না। সে একটু ভীতু প্রকৃতির। হয়তো ভয় পেয়ে কোথাও সরে গেছে। আমরা ঘটনাটি প্রথমে নিহতের পরিবার থেকেই শুনেছি।’
শান্তিগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আকরাম আলী বলেন, ‘ঘটনাটি যেহেতু গ্রিসে ঘটেছে, সেহেতু সেখানে মামলা হবে। তবে নিহতের পরিবার আমাদের কাছে যা যা সহযোগিতা চাইবে, আমরা তা দিতে প্রস্তুত।’