অনলাইনে বিমানের টিকিট কাটার সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট বাংলাদেশ (এফইবিডি)-এর স্বত্বাধিকারী এম এ রশিদ শাহ সম্রাট ও সিইও (সম্রাটের ছেলে) সালমান বিন রশিদ শাহ সায়েম গত শুক্রবার দিবাগত রাতে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। গতকাল শনিবার দুপুরে এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে ফ্লাইট এক্সপার্টের চিফ কমার্শিয়াল অফিসার (সিসিও) সাঈদ আহমদ এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘গতরাতে বাপ-ছেলেসহ সবাই পালিয়ে গেছে। চলে যাচ্ছি-এই মর্মে তারা গতরাতে তাদেরকে মেসেজ দেয়।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা কোথায় যাচ্ছে-এটা জানলে তো আমরা আগেই তাদেরকে ঘেরাও করতাম।’ পিতা-পুত্র পালিয়ে যাবার পর গতকাল শনিবার দুপুরে মতিঝিল থানায় যান বলে জানান এক কর্মকর্তা।
ট্রাভেল এজেন্সি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এফইবিডিতে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির শতকোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। এ বিনিয়োগের কি হবে-এ নিয়ে তারা চরম দুশ্চিন্তায়। গতকাল শনিবার দুপুর থেকে অনেক এজেন্সির মালিক মতিঝিল সিটি সেন্টারে ভিড় করেছেন। রাত ১০টা অবধি সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের ভিড় ছিল। এফইবিডি’র মাধ্যমে পবিত্র ওমরাহসহ বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যে।
টিকেট কাটা রয়েছে অনেক এজেন্সির। ওয়েবসাইট চালু থাকলেও ফ্লাইট সার্চ দিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে, নো রেজাল্টস ফাউন্ড। তাদের অফিসও বন্ধ। ফ্লাইট এক্সপার্টের মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলেরও এজেন্সী টিকেট কাটতো বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
ফ্লাইট এক্সপার্টের অফিসের ফেইসবুকে গিয়ে দেখা গেছে, তাদের সর্বশেষ পোস্ট হজ নিয়ে। সেই পোস্টে হজ্ব ২০২৬ এর রেজিস্ট্রেশন শুরু জানিয়ে হজ প্যাকেজের মূল্য ছাড়া হয়েছে। এম এ রশিদ সম্রাট ফ্লাইট এক্সপার্টের পাশাপাশি মক্কা ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী। তার ছেলে সায়েম মূলত এফইবিডি চালাতেন। এফইবিডি’র ওয়েবসাইটে লেখা যাচ্ছে, তাদের মাদার অর্গানাইজেশন হচ্ছে- মক্কা ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস। গতকাল শনিবার দুপুরে এফইবিডি’র ওয়েবসাইটে ঢোকা গেলেও বিকেল থেকে ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে গতকাল শনিবার দুপুরে মক্কা ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলসের কাস্টমার কেয়ারের সেলফোনে ফোন দেয়া হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনৈক ব্যক্তি বলেন, তিনি ম্যানপাওয়ার সেকশনে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কোথায় এ ব্যাপারে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কারো সাথে কথা বলতে এ প্রতিবেদক আগ্রহ প্রকাশ করলে ওই ব্যক্তি লাইন কেটে দেন।
এম এ রশিদ শাহ সম্রাট হজ্জ এজেন্সিস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর দুই বারের মহাসচিব ছিলেন। ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি পর্যায়ক্রমে দুবার হাবের সেক্রেটারি ছিলেন।
সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, ২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করা এই অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি (ওটিএ) ছিল একটি সুপরিচিত ট্রাভেল ব্র্যান্ড। প্রতিষ্ঠানটি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের টিকিট বুকিং, হোটেল রিজার্ভেশন, ট্যুর প্যাকেজ এবং ভিসা প্রক্রিয়াকরণের মতো নানা ধরনের সেবা দিত। বিশেষ করে, সাশ্রয়ী মূল্যে ফ্লাইট টিকিট বুক করার সহজ সুবিধার কারণে এটি গ্রাহকদের কাছে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। গ্রাহকদের জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় অফার, ডিসকাউন্ট এবং সহজে পেমেন্টের ব্যবস্থা থাকায় এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু, আকস্মিক পোর্টালটি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরী হওয়ায় অনেক ট্রাভেল এজেন্সি পড়েছে বিপাকে। ঢাকার একজন এজেন্সি মালিক জানান, এফইবিডিতে তার ৬০ লাখ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। কিন্তু, পোর্টালটিতে প্রবেশ করতে না পারায় তার এখন মাথায় হাত পড়েছে। পোর্টালে অনেকে ওমরাহসহ বিশ্বের বিভিন্ন গন্তব্যের টিকেট করেছেন। এই টিকেটগুলোর কি হবে-তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)-এর মহাসচিব আসফিয়া সালেহ বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে ওটিএ বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন।
এক্সপার্ট অবৈধভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছিল জানিয়ে তিনি বলেন, লোভসংবরণ করতে না পেরে অনেক এজেন্সি ওটিএ’র প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। ওটিএ একটার সাথে অন্যটার লিংক আছে বলে জানান তিনি। ওটিএ পোর্টালের বিরুদ্ধে আমরা এখন আরো শক্তভাবে দাঁড়াবো। ওটিএ নিয়ে অতীতে অনেক ডিজাস্টার হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা গত ৪/৫ বছর ধরে সরকারের কাছে ওটিএ নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু, তাদের দাবিটি আজো বাস্তবায়িত হয়নি।
আটাব-সিলেট অঞ্চলের সভাপতি জিয়াউর রহমান খান রেজওয়ান জানান, তারা ২০২৪ সালের মার্চ থেকে এজেন্সি মালিকদের ওটিএ ব্যবহার না করার ব্যাপারে সতর্ক করে আসছেন। তাদের সতর্কতায় কর্ণপাত না করায় অনেকে এখন বিপাকে পড়েছেন। আটাব সিলেট জোনের সেক্রেটারি দেওয়ান রুশো চৌধুরী জানান, এফইবিডি বন্ধ হওয়ায় সিলেটের এজেন্সি মালিকদের অর্ধকোটি টাকারও বেশী ক্ষতি সাধিত হবে।
হোয়াটসঅ্যাপে যা লিখেছেন সালমান
প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিইও সালমান বিন রশিদ শাহ সায়েম। সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি লিখেছেন, ‘আপনাদের সঙ্গে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেয়ার করতে চাই। সম্প্রতি একটি পরিকল্পিত বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছি। সাঈদ হোসেন ও সাকিব-এ ঘটনার পেছনে ছিলেন।
গত বৃহস্পতিবারের মিটিংয়ে তারা সমন্বিতভাবে সমস্ত দায় আমার ওপর চাপিয়ে দেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাকে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগও দেওয়া হয়নি। তারা প্রায় ৩ কোটি টাকা তুলে নেন এবং নিজেদের কাছে রেখে দেন। এরপর থেকেই কোম্পানির কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। দায় চাপানো ও হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে আমি শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তার জন্য ছুটিতে যেতে বাধ্য হয়েছি। এভাবে সরে যাওয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।’"