শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:৪৬ অপরাহ্ন

বিয়ে বাড়ির ঐতিহ্য: কলাগাছের গেইট এখন শুধুই স্মৃতি! 

  • প্রকাশের সময় : ১৭/০৭/২০২৫ ১১:১২:১০
এই শীতে ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের কলাগাছের গেইটের বিয়ে এখন শুধুই স্মৃতি
Share
55

সময় পাল্টায়, যুগ পাল্টায়, পাল্টে যায় মানুষের রীতি-নীতিও। কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি থাকে, যেগুলো যত পুরনো হয়, ততই মনকে টানে। আজকের ডিজে আর ডেকোরেটরের জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের আয়োজনের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের প্রাণের ঐতিহ্য—কলাগাছের গেইট আর গ্রাম্য সেই সাদামাটা আনন্দের বিয়ে।


৮০-৯০ দশকের বানিয়াচং বা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গ্রামীণ বিয়েগুলো ছিল একেবারে আপন খুপরি ঘরের উৎসব। তখনকার দিনে বাড়ির সামনে বরযাত্রীর জন্য গেইট বানাতে কলাগাছ, বাঁশ আর রঙিন কাগজই ছিল ভরসা। একেকটা গেইট বানাতে পাড়া-প্রতিবেশীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করত। কেউ বাঁশ কাটত, কেউ কলাগাছ তুলত, কেউ বা রঙিন কাগজের পাখা, শিকল, নিশান বানাত।


বয়োবৃদ্ধ কৃরফান আলী, যিনি এখন নাতির হাত ধরে হাঁটেন, স্মৃতি হাতড়ে বলেন, "ছেলে, এখনকার বিয়েতে হইল ধুমধাড়াক্কা, কিন্তু সেই টান নাই। আগের বিয়েতে বর আইলে বুক দপদপ করত, কলাগাছের গেইট বানাইতে গেলে লগে লগে গোটা পাড়া এক হইয়া যাইত। সেইখানেই আছিল আনন্দ।"


বিয়ের আগে শুরু হতো পিঠা বানানোর উৎসব। জামাই পিঠা, নকশি পিঠা, কাটাকোটি, চিতই—এসব পিঠা বানাতে বাড়ির মেয়েরা রাত জেগে কাজ করত। রান্নাঘর আর উঠানে তখন চলত হাসি-আনন্দের হরিকথা। বিয়ের গীত গাইতেন মা, খালা, বোনেরা— "বউ আইলো লাজে রাঙ্গা, মুঞ্জি পাতার কুড়ান ফাঙ্গা..."


অপর এক বৃদ্ধা ফুলবাহার বিবি বলেন, "বিয়া মানে আছিল মিল-মেলা। বর আইলে লইয়া আসত কেরাই নাওত, ছাউনি দিত নিশান দিয়া। বাজি ফোটাইত, বউর মুখদর্শন হইত কয়দিন পরে। এখন তো বিয়া হইল সিনেমা শুটিংয়ের মতন!"


বরযাত্রীরা নদীপথে নৌকা করে কনে বাড়ি যেত—সাজানো হতো নৌকার ছাদ কলাগাছ, পাটপাতা আর রঙিন কাগজে। বিয়ের দিন রাতভর চলত অনুষ্ঠান, মাইক না থাকলেও বাজত কলের বাশি আর লোকগান। তখনকার বর-কনে ছিলো লাজুক, সাক্ষাৎও হতো বিয়ের পরে এক-দুই দিন পর।


একটি প্রচলিত প্রবাদের কথা মনে পড়ে—"বিয়া বৌয়ের লাজ, আর গেইট পাড়ার গরিমা।" এখন সেই গরিমাও নেই, লাজও নেই।


আজ সেই সব দৃশ্য যেন শুধুই ছবি হয়ে গেছে। এখন বিয়ের গেইট বানায় ডেকোরেটর, ডিজে’র সাউন্ডে হারিয়ে যায় গীতের সুর। কেউ আর পাড়ায় ডাক দেয় না গেইট বানানোর জন্য। পাড়ার বুড়োরা বলেন, "এখন তো কেউ বলেও না, ‘আলি ভাই, গেইট বানাইতে আসেন।’ কলাগাছও আর তেমন মেলে না।"


এক সময়ের ঐ গেইট বানাতে শেষে বরপক্ষের দেওয়া এক কাপ চা বা হালুয়াই ছিল পাড়ার লোকজনের আনন্দ। "চা দিয়া খুশি, হালুয়া দিয়া তৃপ্ত। এই আছিল বিয়ের দাওয়াত।"


গ্রামীণ বিয়ের যে ঐতিহ্য—উল্লাস, পিঠা, গান আর কলাগাছের গেইট, সব এখন শুধু গল্প হয়ে বাঁচে। নতুন প্রজন্ম হয়তো বিশ্বাসই করবে না যে, একটা সময় ছিল, যখন গেইট বানানো মানেই ছিল গোটা পাড়া মিলে উৎসবের শুরু।


আজ সেই সবকিছু আধুনিকতার ঢেউয়ে ভেসে গেছে। বিয়ের বাড়ির সেই প্রাণের উল্লাস আর হৃদয়ের বাঁধন যেন কেবলই স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নিচ্ছে।


সিলেট প্রতিদিন / Sl


Local Ad Space
কমেন্ট বক্স
© All rights reserved © সিলেট প্রতিদিন ২৪
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি