মোঃ আবদাল মিয়া, বানিয়াচং: একটি প্রবাদ আছে “কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ”। গত পাঁচ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের পর পুলিশ বাহিনীর নিস্ক্রিয়তার সুযোগ পেয়ে মাদকের অবাধ বিস্তৃতি দেখে তেমনটিই মনে হচ্ছে। বানিয়াচং উপজেলার বিভিন্ন অলি গলিতে হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক! উদ্বিগ্ন হয়ে রয়েছেন অভিভাবকরাও !
ছাত্র জনতার আন্দোলনে পুলিশ নির্যাতন, নিপীড়নের রোষানলে পড়ে ও বিগত সরকার পতনের সাথে পুলিশের কার্যক্রম একেবারেই থেমে যায় ! প্রাণভয়ে পুলিশ কর্মস্থল থেকে পালিয়ে আত্নগোপনে চলে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে পুলিশের স্থাপনাসমূহ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লুটপাট হয় অস্ত্রসহ বিভিন্ন অতীব প্রয়োজনীয় সামগ্রী। অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় অনেক স্থাপনা ! পুলিশের গুলিতে নিহত হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে অংশ নেওয়া আট সদস্য ও জনতার হাতে গণপিটুনিতে নিহত হয় এক সাংবাদিক ও পুলিশ সদস্য! আন্দোলনে ছাত্র জনতার ওপর পুলিশের নির্মম আচরণ সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি তাই তারা জনরোশের শিকার হয়েছে একথা যেমন সত্য তেমনি লুটেরা ও অপরাধ প্রবণ জনগোষ্ঠী পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে অসাধু উদ্দেশ্যে মাঠে নেমে পড়েছে তাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুলিশ প্রশাসনকে সঠিক কার্যক্রম ও কঠোর পদক্ষেপের নির্দেশনা দিয়েও অপরাধ প্রবণতা ঠেকাতে এখনও পুরোপুরি সম্ভব হয়ে উঠেনি। বলা যায়, পুলিশি ব্যবস্থা এলাকায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা, চুরি, ছিনতাইয়ের দিকে কিছুটা নজর দিলেও মাদক সম্রাটদের বৃহৎ সাম্রাজ্য এক প্রকার অকার্যকর অবস্থায় রয়ে গেছে। পুলিশের এহেন অবস্থায় মদ, গাঁজা, ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, হুইস্কি, বিয়ারসহ নেশা জাতীয় ট্যাবলেট মহানন্দে দেদারছে বিক্রি করছে মাদক ব্যবসায়ীরা। তাদের জন্য যেন প্রবাদ বাক্যের পৌষ মাস চলছে।
মাদক ব্যবসা ও সেবন প্রায় বাধাহীন অবস্থায় পৌঁছে গেছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ভূমিকা কখনই তেমন কার্যকর ছিল না বরং এই সর্বনাশা ব্যবসায় তাদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তারপরও যতটুকু ভূমিকা ছিল তাও না থাকায় মাদক সেবন এবং রমরমা ব্যবসায় পরিণত হয়ে গড়ে ওঠেছে নতুন এক সাম্রাজ্য। মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধ চরম সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে উপজেলা সদরের বড়বাজারের বাসস্ট্যান্ড, কামালখানী রাস্তার জীপ স্ট্যান্ড, আদর্শ বাজারের নৌকা ঘাট, রঘু চৌধুরীপাড়ার ভূমি অফিসের মোড়, নতুন বাজার থেকে বড়বাজার যেতে টাম্বুলীটুলার 'স' মিল, এলাড়িয়ার মাঠে পশ্চিমের রাস্তার মোড়, বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের রাস্তার পয়েন্ট, সাগরদিঘীর দক্ষিণপাড়, জনাব আলী সরকারি কলেজের পিছন, ছিলাপাঞ্জার মোড়, ঠাকুরাইন দিঘীর পাড় সংলগ্ন বানেশ্বর বিশ্বাসের পাড়ার ব্রিজ, নতুনবাজার বড়বাজার রোডের বাংলালিংক টাওয়ারের কাছে, মাদানি ম্যানসনের উত্তরে, খাদ্য গুদামের পিছন, মহিলা কলেজ রোডের কয়েকটি চায়ের দোকান, পাড়াগাঁও বউ বাজার, পাড়াগাঁও খেলু মিয়ার পরিত্যক্ত ঘর, নতুন বাজার পশ্চিমের স্ট্যান্ড, পশ্চিম যাত্রাপাশার মুচি বাড়ি, তৎসংলগ্ন অপর একটি বাড়ি, মধ্য যাত্রাপাশা বটের বাড়ির দক্ষিণে, বাইন্না মহল্লা সরকারি ঘর, কুন্ডুরপাড়ের ব্রিজসহ আরো বেশ কয়েকটি জায়গায় ভাসমান অবস্থায় মাদক সেবন ও কেনাবেচা হয়।
এছাড়া প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও অবাধে চলছে মাদক কারবারিদের রমরমা ব্যবসা। এসব এলাকায় মাদক ব্যবসা দিন দিন আরও বিস্তৃত হচ্ছে।
আগে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হতো গুটি কয়েক চিহ্নিত ক্ষমতাশালী ব্যক্তির হাতে, ক্ষমতার পালাবদলে তারা গা ঢাকা দিয়েছে, পাশাপাশি পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় অসংখ্য মাদক সম্রাট গজিয়ে উঠেছে। নিরীহ এলাকাবাসী কোন রকম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না কিছু পাতি নেতার ক্ষমতায়ন ও শিথিল আইন শৃঙ্খলাজনিত কারণে।
হাতের মুঠোয় মাদকদ্রব্য চলে আসায় মাদক সেবীর সংখ্যাও আশংকাজনক হারে বেড়ে চলেছে। ওঠতি কম বয়সী বালকসহ তরুণ যুবক, স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র, রাজনৈতিক নেতাসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ মরণ নেশায় আসক্ত হয়ে যেমন ধ্বংস করছে নিজেকে তেমনি সমাজের কিছু নামি-দামি উচ্চবিত্ত পরিবারেরও সর্বনাশ ঢেকে আনছে। কিশোর শ্রেণীর বড় একটি অংশ নতুন করে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদক নেশার অর্থ সংগ্রহ করতে চুরি, ছিনতাইয়ের কাজেও লিপ্ত হচ্ছে। তরুণ সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়া দেশ ও জাতির জন্য সবসময়ই অন্যতম প্রধান সমস্যা। এ সমস্যা সমাধান কল্পে বিভিন্ন সময়ে মাদক নিয়ে সভা, সেমিনার, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে স্থানীয়রা। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও তা কখনই কার্যকর হয়নি, থেকে যায় শুধু কাগজে-কলমে।
এর প্রধান কারণ হলো লাভজনক এ ব্যবসায় ক্ষমতাবান ব্যক্তি এবং প্রশাসনের কিছু অসাধু ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা। তরুণ ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে যখন দেশে অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থান ঘটে গেল তখন একই প্রজন্মের বড় একটি অংশ মাদকের ভয়াল থাবায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ভাবতে অনেক কষ্ট হয়। দীর্ঘ দিনের প্রকট সমস্যাসমূহ রাতারাতি দূর করা সম্ভব নয় বটে সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হলেও কিছু সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন।
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত উন্নত ও কার্যকর করার পাশাপাশি মাদক নিয়ন্ত্রণ এবং তরুণ সমাজের বড় একটি অংশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন করে গজিয়ে ওঠা মাদক ব্যবসায়ীদের কঠোর হাতে দমন করতে না পারলে জাতির জন্য অপেক্ষা করছে ভয়ঙ্কর এক পরিনাম। মাদকাসক্ত প্রতিটি ব্যক্তি ভাল-মন্দের ফারাক বুঝতে অক্ষম। তারা অসুস্থ, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা উচিত বলে মনে করেন সচেতন মহল।
মাদক ব্যবসায়ীদের কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তির আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। আত্মসম্মান হারানো পুলিশ বাহিনী মাদক নির্মূলে কার্যকর ভুমিকা রেখে জনগণের পুলিশি আস্তা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলে তা হবে পুলিশ বাহিনীর বড় সফলতা। জাতি পাবে মাদক মুক্ত দেশ।
মাদকের ভয়াল থাবায় দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলই আক্রান্ত। পর্যটন সমৃদ্ধ বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম বানিয়াচং তুলনামূলক বিচারে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।অপরাধ প্রবণতা এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্যও বানিয়াচং উপজেলার নাম বারবার সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে।
হেন কর্মকান্ডের অন্যতম প্রভাবক হলো মাদক। মাদক নির্মূল করতে পারলে সিংহভাগ অপরাধ কমে আসবে। কতিপয় অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু দুর্বৃত্তের কারণে সন্ত্রাস ও মাদকের জনপদে পরিণত হয়েছে বানিয়াচং। বানিয়াচংবাসী এমন কলঙ্ক থেকে মুক্তি চায়। বিভিন্ন কারণে এতদিন যা সম্ভব হয়নি তা সম্ভব করার সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। কলঙ্ক মুক্ত করার এই সম্ভাবনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন এলাকাবাসীর সমন্বিত প্রয়াস, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাগত দায়িত্ব পালন এবং জবাবদিহিতা। এমন সম্মিলিত প্রয়াস নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসলে বানিয়াচং উপজেলা পরিণত হবে প্রকৃত অর্থেই শান্তির জনপদ, এমন প্রত্যাশাই করছেন সমাজের সচেতন সুনাগরিকগণ।
এ ব্যাপারে বানিয়াচং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা বলেন, মাদক বিষয়ে বানিয়াচং উপজেলায় মাদক নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্স নীতিতে রয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত মাদকের অভিযান পরিচালনা করে আসামি গ্রেফতার করা হচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রণে পুলিশি অভিযান অব্যাহত আছে ও ভবিষ্যতেও থাকবে।