সুরমা নদী ভাগ করেছে সিলেট নগরকে। দক্ষিণ অংশে ৯টি ওয়ার্ড। এ ওয়ার্ডগুলো শহরের অন্তর্ভুক্ত। ২০০২ সালে যখন সিলেট সিটি করপোরেশন গঠন করা হয় তখন দক্ষিণ অংশের তিনটি ওয়ার্ডকে নগরের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
এরপর থেকে সিলেট সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি সিলেট-১ আসনের অন্তর্ভুক্ত এই ওয়ার্ডগুলো। এগুলো হচ্ছে ২৫, ২৬ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ড। ২০২২ সালের সিলেট সিটি করপোরেশনের সীমানা বর্ধিত করেন সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তখন তিনি দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সাবেক কুছাই ও বরইকান্দি ইউনিয়ন ভেঙে আরও ৬টি ওয়ার্ড করেন। দক্ষিণ সুরমা উপজেলার অন্তর্ভুক্ত থাকা ওই ওয়ার্ডগুলো এখন সিলেট সিটি করপোরেশনের অংশ। তবে তারা এখনো সংসদীয় আসন সিলেট-৩ দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনে সীমানা নির্ধারণের যে প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে দেখা গেছে সিলেট-৩ আসনে নতুন করে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বলা হচ্ছে পুরাতন তিনটি ২৫, ২৬ ও ২৭ নং ওয়ার্ডকে। আর এই প্রস্তাবে নাখোশ দক্ষিণ সুরমার তিন ওয়ার্ডবাসী।
তাদের যুক্তি ২০০২ সাল থেকে তারা সিলেট সিটি করপোরেশনের সঙ্গে। ওই সময় থেকে তাদের সঙ্গে সিলেট-১ আসনের সব কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত।
একইসঙ্গে নগরের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই ওয়ার্ডগুলো নিয়ে ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে তাদের সিলেট-৩ আসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হলে তারা পরবর্তীতে উন্নয়ন বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এজন্য তারা নির্বাচন কমিশনে যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে সে প্রস্তাবে আপত্তি জানাচ্ছেন। হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশনে এ প্রস্তাব দেয়ায় রাজনৈতিক নেতারাও অবাক। তারা জানিয়েছেন- আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনী এলাকায় তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ইতিমধ্যে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে তারা কাজ এগিয়ে রাখছেন।
এই অবস্থায় আসন ভাগ-বাটোয়ারায় নগরের ওই অংশের সংসদীয় আসন বদল হলে জনগণ হতাশ হবেন। সিলেট-১ আসন থেকে ২০১৮ সালে বিএনপি’র হয়ে নির্বাচন করেছিলেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। এবারো দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় তিনি মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। সীমানা নির্ধারণ প্রসঙ্গে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির মানবজমিনকে জানিয়েছেন- নগরের দক্ষিণ অংশের ওই তিনটি ওয়ার্ড সিলেট-১ আসনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত থাকলে আমরা খুশি হবো।
কারণ- দীর্ঘদিন ধরে তাদের সুখে, দুখে আমরা রয়েছি। ওই তিনটি ওয়ার্ডে নির্বাচনী কার্যক্রমও চলছে। ফলে আমরা চাইবো পূর্বের সীমানায় যেন থাকে সিলেট-১ আসনের পরিধি। রাজনৈতিক নেতারা জানিয়েছেন- নির্বাচন কমিশন ভোটারের হিসাবে সিলেট-১ আসন থেকে তিনটি ওয়ার্ডকে সিলেট-৩ আসনের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে। কিন্তু সেখানে দেখা গেছে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার ভোটার সিলেট-১ আসন থেকে চলে যাবে। আর ভোটার বাড়বে সিলেট-৩ আসনে।
কিন্তু পরিধি বিবেচনায় সিলেট-৩ আসনটি হচ্ছে সিলেটের অন্যতম বড় একটি আসন। এ আসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত চারটি এলাকা। এর মধ্যে রয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশন, দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ। ফলে এ আসনে যেমন নগরের অংশ রয়েছে তেমনি রয়েছে হাওরসহ গ্রামীণ জনপদ। একজন জনপ্রতিনিধি দিয়ে সবখানেই সমান উন্নয়ন সম্ভব নাও হতে পারে। এতে দেখা যাবে সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত এলাকাগুলো অবহেলিত থেকে যাবে। এজন্য সিলেট দক্ষিণ অংশের তিন ওয়ার্ডের বাসিন্দারা সিলেট-১ আসনের সঙ্গে থাকতে চাইছেন। ভবিষ্যতে নগরের দক্ষিণ অংশ নিয়ে আরেকটি সংসদীয় আসন হতে পারে বলে জানান তারা।
এদিকে- নতুন করে সীমানা নির্ধারণের এই প্রস্তাবে নগরের ওই তিনটি ওয়ার্ডের বাসিন্দারাও ক্ষুব্ধ। হঠাৎ এই প্রস্তাবে তারা ব্যথিত। এজন্য গতকাল শুক্রবার রাতে দক্ষিণ সুরমার গোটাটিকর এলাকার তিনটি ওয়ার্ডের মুরুব্বিদের নিয়ে বৈঠক হয়েছে। নগরের দক্ষিণ অংশের কদমতলী এলাকার বাসিন্দা এডভোকেট তাজউদ্দিন মানবজমিনকে জানিয়েছেন- নগরের পুরাতন তিনটি ওয়ার্ড ২০০৩ সাল থেকে সিটি করপোরেশন ও পরবর্তীতে সিলেট-১ আসনে ভোট দিয়ে আসছেন। নগরের মূল স্রোতের সঙ্গে ওই তিনটি ওয়ার্ড সম্পৃক্ত। নগরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাও তিনটি ওয়ার্ড। নির্বাচন কমিশনে নতুন করে সীমানা নির্ধারণের যে প্রস্তাব করা হয়েছে সে প্রস্তাবে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে। কেউ চায় না সিলেট-৩ আসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে।
এজন্য তিনটি ওয়ার্ডের মানুষজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ধীরে ধীরে প্রতিবাদের মাত্রাও বাড়ছে বলে জানান তিনি। সিলেট ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন- নির্বাচন কমিশনে যে প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি অযৌক্তিক বলে বিবেচিত করা হচ্ছে। এই প্রস্তাবে তিন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের দ্বিমত রয়েছে। গতকাল এ নিয়ে নগরের বঙ্গবীর রোড এলাকায় সভা করা হয়েছে। যদি বর্তমান সীমানা না থাকে তাহলে এলাকার মানুষ আইনি লড়াইয়েও নামতে পারেন।
এদিকে- সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৫, ২৬ ও ২৭ নং ওয়ার্ডকে সিলেট সংসদীয় আসন ১ থেকে ৩ নেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবীর রোডে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তারা বলেছেন- ‘সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমাদের এই ৩টি ওয়ার্ড সংসদীয় আসন সিলেট-১ আসনের সঙ্গে আছে। আমাদের সকল ধরনের প্রয়োজনী কাগজপত্রসহ সব কিছুতে আমরা সিলেট-১ আসনের অধীনে রয়েছে। হঠাৎ করে এ ধরনের প্রস্তাবনা সঠিক নয়। আমরা মনে করি এটি একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। যদি কোনো কারণে আমাদের সিলেট-১ থেকে ৩ সংসদীয় আসনে হস্তান্তর করার কোনো পরিকল্পনা করা হয় তাহলে বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তারা।’
নগর বিএনপি’র সহ-সভাপতি আফজল উদ্দিনের সভাপতিত্বে ও মহানগর বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামের পরিচালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন- নগর বিএনপি’র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুর্শেদ আহমদ মুকুল ও আখতার রশিদ চৌধুরী, সমাজসেবা সম্পাদক ডা. এম এ হক বাবুল, ২৭নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সভাপতি নাজিম উদ্দিন, ২৭নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম, মহানগর বিএনপি’র মৎস্য বিষয়ক সম্পাদক দুলাল আহমদ, কৃষি বিষয়ক সম্পাদক মফিজুর রহমান জুবেদ, ২৫নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ ফয়েজ আহমদ শিপু, ২৫নং ওয়ার্ড বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশাহিদ আহমদ, ২৬নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক ময়নুল ইসলাম ইমন, মহানগর ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক আজহার আলী অনিক, ২৬নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের আহ্বায়ক হাবিব আহমদ প্রমুখ।