টগবগে তরুণ পাগল হাসানের দুঃখের জীবন ছিল। গান লিখতে হলে নাকি ‘বুকভরা পরম দুঃখের’ দরকার। নিজেই এমনটি বলেছিলেন। সেই দুঃখবোধ তাঁর গান, সুর ও সাধনায় প্রকাশ পেয়েছে। ছোটবেলায় বাবাকে হারান। কঠিন দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন। ‘মনের দুঃখ’ না মিটলেও একটু বৈষয়িক সুখ যখন উঁকি দিচ্ছিল, ঠিক তখন পথেই থেমে গেল তাঁর ‘ভাবজীবনের রেলগাড়ির ইঞ্জিন’।
‘জীবন খাতায় প্রেম কলঙ্কের দাগ লাগাইয়া’ গানের কারিগর পাগল হাসান দুঃখের জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। সেই জীবন থেকে ছুটি পেয়েছেন তিনি। সুনামগঞ্জের তরুণ সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও সুরকার মতিউর রহমান হাসান ওরফে পাগল হাসানের মৃত্যুর পর তাঁকে যেন কাছের মানুষই নতুন করে চিনেছেন। তাঁর জন্য কেঁদেছেন অনেকে।অথচ সাদাসিধে এই তরুণ হাসান সবার কাছে ও সবার মাঝে থেকেই যেন ছিলেন অচেনা। আর এখন, তাঁর গানের কথার মতোই হয়েছে—‘মানুষ মইরা গেলে কদর বাইড়া যায়, বাঁইচা থাকতে নিকৃষ্ট কয়, মরলে শ্রেষ্ঠ পদক পায়..।’
বৃহস্পতিবার সকালে মৃত্যুর খবরে তাঁর ভক্ত-অনুরাগী, বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ীরা হতবাক হয়ে যান। দিনভর তাঁকে নিয়ে আলোচনা, কত শত গল্প, শোকগাথা ছিল মানুষের মুখে মুখে। সকালে ছাতকে, বিকেলে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে তাঁর জন্য বিলাপ করেছেন অগণিত তরুণ। সন্ধ্যায় শিমুলতলা গ্রামে হাজার-হাজার মানুষ অশ্রুসজল চোখে শেষ বিদায় জানান তাঁকে।
নিজের পরিচয় নিজেই ‘পাগল হাসান’ বলে দিতেন। গানে বলতেন নিজের দুঃখের কথা। ‘নদীর বুকে চান্দে খেলায়/ জলের বুকে মিন/ পাগল হাসানের বুকেতে দুঃখ সীমাহীন..।’ শিমুলতলা সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার একটি গ্রাম। গ্রামটির কৃষক দিলোয়ার হোসেন ওরফে দিলশাদ ও আমিনা বেগমের একমাত্র ছেলে হাসান। তাঁদের আরও তিন মেয়ে আছেন। হাসান তৃতীয় সন্তান।
বাবা দিলোয়ার যখন মারা যান, তখন হাসানের বয়স মাত্র পাঁচ বছর। এরপর আমিনা বেগম ছেলেমেয়েদের নিয়ে অকূল দরিয়ায় ভাসেন। সন্তানদের বড় করতে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগাড় করতে নিজে শ্রমিকের কাজ করেছেন। সংসারের টানাপোড়েনে হাসানকেও নানা জায়গায় কাজ করতে হয়েছে। মা অনেক চেষ্টা করে সন্তানদের কিছু লেখাপড়া করিয়েছেন। সংসারের হাল ধরতে একপর্যায়ে হাসান সরকারি টেকনিক্যাল স্কুলে অফিস সহায়কের চাকরি নেন।
হাসানের মামা রবিউল হাসান বলেন, বড় অভাবে দিন গেছে তাঁদের। এখনো অভাব আছে। কিন্তু কখনো সেই কষ্টের কথা, দুঃখের কথা হাসান কাউকে বলেননি। চাপা স্বভাবের ছিলেন হাসান। এখনো ভাঙা ঘরই আছে। দুই চালা দুই কক্ষের টিনের বেড়া ও টিনের চালার ঘরে মা, স্ত্রী, দুই ছেলে আর ছোট বোনকে নিয়ে থাকতেন। গানটান গেয়ে যা পেতেন, বেশির ভাগই অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। নিজের কষ্টের কথা ভোলেননি। হাসান ছোটবেলা থেকে কষ্ট কী জিনিস বুঝেছেন? তাই অন্যের কষ্টে তাঁর মন কাঁদত। গানের প্রতি সব সময় তাঁর টান ছিল। এলাকায় কোথাও গানের আসর বা জলসা হলেই হাসান সেখানে হাজির হতেন। সুনামগঞ্জ শহরে চাকরি করার সময় বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী ও সংগীত প্রশিক্ষক দেবদাস চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।
সংগীতশিল্পী পাগল হাসানের প্রতি সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানান। বৃহস্পতিবার বিকেলে সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে
সংগীতশিল্পী পাগল হাসানের প্রতি সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানান।বৃহস্পতিবার বিকেলে সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণেছবি: প্রথম আলো
দেবদাস চৌধুরী বলেন, ১৫ বছর আগের কথা। শহরে কোনো অনুষ্ঠান হলেই হাসান যেতেন। একপর্যায়ে তিনি গান শিখবেন বলে স্পন্দন সংগীত বিদ্যালয়ে যুক্ত হন। পরে তিনি গানও লেখেন। তাঁর গানের কথা দেখে তিনি (দেবদাস চৌধুরী) অবাক হন। কথার গভীরতা, আধ্যাত্মিকতার টান সবাইকে মুগ্ধ করে। সেই থেকে শুরু। মঞ্চে তিনি আলো ছড়াতে শুরু করেন নিজের লেখা ও সুর করা গান দিয়ে। শহরে তরুণদের একটা গ্রুপের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তাঁরা কেউ গান, কেউ অভিনয় করেন। একপর্যায়ে হাসান চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি গানে ডুবে যান। ঢাকাসহ সবখানেই তিনি গান করতে থাকেন। ইউটিউবে তাঁর গান জনপ্রিয় হতে থাকে। তাঁর একটা গানের দল ছিল ‘পাগল এক্সপ্রেস’ নামে।
হাসানকে হাওর জনপদ সুনামগঞ্জের বাউল সাধকদের উত্তরসূরি হিসেবে দেখেন দেবদাস চৌধুরী। বলেন, তাঁর (হাসানের) লেখা গানের সংখ্যা প্রায় এক হাজার। তাঁর গায়কিতে অন্য রকম এক মায়া, বাউলিয়ানা ছিল, যা সবাইকে আকৃষ্ট করত। ২০১১ সালে হাসান বিয়ে করেন সুনামগঞ্জ শহরের বাসিন্দা লুৎফা বেগমকে। তাঁর দুই ছেলে। বড় ছেলে মাকসুদুর রহমান জিনান (১৫) সুনামগঞ্জ শহরের জামেয়া ইসলামিয়া মদনিয়া মাদ্রাসায় এবং ছোট ছেলে মুশফিকুর রহমান জিসান (১৪) সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
হাসানের জনপ্রিয় গানের মধ্যে—‘আসমানে যাইওনারে বন্ধু ধরতে পারব না/ পাতালে যাইওনারে বন্ধু ছুঁইতে পারব না/ বুকের ভিতর রইওরে বন্ধু, বুকের ভিতর রইও/ অন্তরে অন্তর মিশাইয়া পিরীতের গান গাইও.., ‘জীবন খাতায় প্রেম কলঙ্কের দাগ লাগাইয়া/ ছাড়িয়া যাইওনারে বন্ধু মায়া লাগাইয়া.., ‘দুই দিনের সংসারি আর মিছা দুনিয়াদারি/ তোর চরণে দিলাম বিকাইয়া..’, ‘ কইরো ঘৃণা যায় আসে না/ তবেই যাবে মনের তাপ/ আল্লাহর ওয়াস্তে কইরা দিয়ো মাপ..’,‘ জানতাম যদি তোমার পিরিত কচুপাতার পানি/ তবে কি আর কুল হারাইয়া হইতাম অপমানিরে বন্ধু. ‘দেহ কুপির তেল ফুরাইবে, জ্বলবে না রে বাতি, অনন্তকাল একলা রইবে, হইবে না কেউ সাথী’ উল্লেখযোগ্য।