শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৬ পূর্বাহ্ন

শেখ ফজলুল হক মণি’র সংক্ষিপ্ত জীবনী

  • প্রকাশের সময় : ০৪/১২/২০২২ ১১:৫৫:২৪
এই শীতে ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের
Share
14

পরিবার: শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ ফজলুল হক মণির পিতা তদানীন্তন ফরিদপুর মহকুমার জমিদার কুদরত উল্লাহ শেখের (কুদ শেখ) পুত্র নূরুল হক। তিনি উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে ব্রিটিশ সরকারের (এজিবির) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এবং শেখ মণির মাতা আছিয়া বেগম ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় বোন। শৈশব থেকেই আপন মামা এবং বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদরে-অনুকরণে বেড়ে উঠেছেন শেখ ফজলুল হক মণি। শেখ ফজলুল হক মণির স্ত্রী আরজু মনি সেরনিয়াবাত।

শেখ ফজলুল হক মণির দুই সন্তান: শেখ ফজলে শামস্ পরশ ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

পড়াশোনা: শেখ ফজলুল হক মণি নবকুমার ইনস্টিটিউটে থেকে ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৬০ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৬২ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এ সময় তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। এ ছাড়া কারাবন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৬৭ সালে আইনশাস্ত্রে এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।

৬২’র শিক্ষা আন্দোলনের নায়ক শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি: ১৯৬০-১৯৬৩ সালে শেখ ফজলুল হক মণি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের ডাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধর্মঘট ও সামরিক আইন অমান্য করে রাজপথে মিছিল বের করলে পুলিশ লাটিচার্জ-টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে বহু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। দেশব্যাপী এই শিক্ষা আন্দোলনকে গতিময় করে তুলতে ৬২-র ২ আগস্ট তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি, ডাকসুর সহ-সভাপতি শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ও জি.এস. এনায়েতুর রহমান সহ বাম সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে জেলাসমূহে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।

এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি গ্রেফতার হন। কুখ্যাত শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্রলীগ হয়ে উঠে ছাত্র-জনতার দুর্দিনের কান্ডারী।১৭ সেপ্টেম্বর সারাদেশে অভূতপূর্ব হরতাল ও ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। রাজপথে নিহত হন বাবুল এবং বাস কন্ডাক্টর মোস্তফা। গৃহভৃত্য ওয়াজিউল্লাহ গুরুতর আহত হয় এবং তিনি ১৮ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।১৭ সেপ্টেম্বর কার্যত ছাত্রসমাজের অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ঐ দিনের বিক্ষোভ মিছিলে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই প্রধান হয়ে ওঠে।

ওই দিন শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে মিছিলের উপর পুলিশ হামলা চালায়। টঙ্গিতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করে সুন্দর আলী নামে এক শ্রমিককে।১৭ সেপ্টেম্বরের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড দমন-পীড়ন ও প্রতিকূলতার মধ্যেও ছাত্রসমাজ আন্দোলন অব্যাহত রাখে। একপর্যায়ে সরকার নমনীয় হতে বাধ্য হয়। ছাত্রসমাজ ও আন্দোলনকারী জনগণের পক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর গোলাম ফারুকের সাথে আলোচনায় বসেন। ২৪ সেপ্টেম্বর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম পল্টন ময়দানে জনসভা আহ্বান করে।ঐ জনসভা থেকে সরকারের প্রতি ‘চরমপত্র’ দেওয়া হয়। ছাত্রসমাজের এই ‘চরমপত্র’ দেওয়ার তিন দিন পর, সরকার শরীফ কমিশন রিপোর্ট স্থগিত ঘোষণা করে। ১৯৬৩ সাল থেকে ছাত্রসমাজ ১৭ সেপ্টেম্বর দিনটিকে প্রতিবছর ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। সেই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম ও পতাকা নির্মাণে শেখ ফজলুল হক মণি’র অবদান: ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশন আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচার আইয়ুব সরকার মার্শাল ল প্রত্যাহার করে মৌলিক গণতন্ত্র ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।এ সময় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি আবার সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি আধুনিক চিন্তাধারার সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের প্রতিবাদী কৌশল অবলম্বন করে ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম এবং পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর অনুরোধেই দেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম ও পতাকার মৌলিক ধারণা প্রণয়ন করেন। এ কাজে সহযোগী হিসেবে যুক্তি-পরামর্শদান করেন বিখ্যাত বাংলা লৌকসাহিত্য শিল্পী অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন।শেখ ফজলুল হক মণির দেশপ্রেমে সংগ্রাম ও প্রতিবাদের কৌশলগত রূপরেখায় চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক ও চিরায়িত বাংলার ঐতিহ্য নৌকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ছাত্রসংগঠনের মনোগ্রামের মধ্যাংশে নৌকার আকৃতি ব্যবহার করেন।

তৎকালীন পূর্ব বাংলার সোনালি আঁশ ছিল ‘পাট’। যেহেতু পূর্ব বাংলার কৃষি খাতের স্বর্ণালি ফসল পাটের রপ্তানীকৃত লাভজনক অর্থের বেশির ভাগই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা অন্যায্যভাবে নিয়ে যেত; সেই প্রতিবাদে ছাত্রলীগের মনোগ্রামের দুই পাশে পাট পাতা আকৃতির ব্যবহার করা হয়েছে এবং শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির উদ্দেশ্য সামনে রেখে তিন তারকা চিহ্ন এবং স্পষ্ট বাংলা অক্ষরে ওপরে পূর্ব বাংলা ও নিচে ছাত্রলীগ লিখে চিরায়িত বাংলার ঐতিহ্য গাঢ় সবুজ রঙের পটভূমি ব্যবহারে করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম প্রস্তুত করা হয়েছিল।একই চিন্তাধারায় শেখ ফজলুল হক মণির পরামর্শক্রমে দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে শান্তির রং সাদা পটভূমিতে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে তিনটি অগ্নিশিখা চিহ্নের ওপর শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির মন্ত্রে লাল রঙের তিন তারকা চিহ্নের রূপ দিয়ে ছাত্রলীগের দলীয় পতাকার আকৃতি নিরূপণ করেছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের এই রূপকল্প অনুযায়ী ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম ও পতাকা তৈরির শিল্পকর্মে শেখ ফজলুল হক মণির সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ের প্রতিবাদী বার্তায় বাঙালির ন্যায্য অধিকার লুণ্ঠনের চিত্রকর্ম চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুললেন তাঁরই ছাত্র তখনকার নামকরা চিত্রশিল্পী হাশেম খান যা আজও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দলীয় মনোগ্রাম ও পতাকা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

৬ দফা আন্দোলন ও শেখ ফজলুল হক মণি: বাঙালি জাতির স্বকীয় মহিমায় আত্মপ্রকাশ আর আত্মনির্ভশীলতা অর্জনের চাবিকাঠি ‘ছয় দফা আন্দোলনে শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন একনিষ্ঠ ও সফল সংগঠক। ‘ছেষট্টির সাত জুন-প্রস্তুতি পর্ব’ নিবন্ধ পাঠে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকায় এবং মওলানা ভাসানীর ন্যাপসহ আরও কিছু সংগঠনের আপত্তি থাকায় ছয় দফার পক্ষে জনসমর্থন আদায় এবং হরতাল সফল করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। ৭ জুন ১৯৭২ সালে প্রকাশিত ওই নিবন্ধে শেখ মণি লিখেছেন, ‘...জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছেন হরতালের প্রস্তুতি কতদূর কী হলো সেটি সম্পর্কে। গভীর রাতে পেছনের দেওয়াল টপকিয়ে ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গেলাম। মামিকে বিস্তারিতভাবে সবকিছু জানিয়ে বললাম রাতের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কাছে খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য। হরতাল হবেই।’ ‘মানিক মামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম।

তিনি বললেন, ইত্তেফাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও তিনি পিছপা হবেন না। শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য তিনি সবকিছু করবেন।’শেখ মণি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের পথসভা ও গেট সভা করতে বললেন এবং সমস্ত ঢাকাকে ১১টা ভাগে ভাগ করে দায়িত্ব বণ্টন করে দিলেন। তেজগাঁও, আদমজী পোস্তগোলাসহ শ্রমিকদের তিনি সংগঠিত করেছিলেন। শেখ মণিকে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘ দুই বছর আট মাস কারান্তরীণ রাখা হয়।তিনি মুক্তি পান ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর।

বঙ্গবন্ধুর ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে বিভিন্ন প্রসঙ্গে শেখ ফজলুল হক মণি: বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থের ২০২, ২০৯, ২১০, ২১৩, ২২৩, ২৩৫, ২৪০, ২৮১, ২৪৮, এবং ২৬৩ নং পৃষ্ঠায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে শেখ ফজলুল হক মণি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। কারাবাসের নির্মম জীবনকথা ব্যক্ত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন: “ন্যাপের হালিম, ভাগ্নে মণি পুরানা হাজত থেকে তারা এসেছে। এক জেলে থাকি আমার ভাগ্নে আমার সাথে দেখা করতে পারে না। কি বিচার!” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ.২০২)। ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বেগম মুজিব, শেখ রেহেনা ও শেখ রাসেল জেল গেটে জন্মদিনের কেক আর ফুল নিয়ে যায়।বঙ্গবন্ধু বলেন, “রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেটে থেকে। ওর সাথে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।” (কারাগারের রোজনামচা, পৃ. ২১০)।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের কর্মসূচির অন্যতম প্রণেতা শেখ ফজলুল হক মণি: শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের কর্মসূচির অন্যতম প্রণেতা। শেখ ফজলুল হক মণি সত্তরের নির্বাচনী কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন, পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশকে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন, ব্যাংক-বিমা ও ভারী শিল্প, বৈদেশিক বাণিজ্য, পাট ও তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ, পূর্ব পাকিস্তানের জায়গিরদারি, জমিদারি ও সর্দারি প্রথার উচ্ছেদ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ভারী শিল্পের শতকরা ২৫ ভাগ শেয়ার ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসন ইত্যাদি।

মুজিব বাহিনী ও শেখ ফজলুল হক মণি: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান গেরিলা বাহিনী মুজিব বাহিনী শেখ মণির নির্দেশে ও প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গঠিত এবং পরিচালিত হয়। প্রায় পাঁচ হাজার সদস্যের এ বাহিনীকে চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাক।  ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল উবানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেরাদুন পাহাড়ি এলাকায় এ বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে শেখ মণি ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মুজিব বাহিনী যুদ্ধ করেছে। তারা দখলদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন এবং ঢাকার আশেপাশে বেশ কিছু দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে।মুজিব বাহিনীর সদস্যরা গেরিলা রণকৌশল বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ছিল এবং তারা ছিল তুলনামূলকভাবে উন্নত অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত। স্বাধীন-সার্বভৌম লাল সবুজের পতাকা খচিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এই মুজিব বাহিনীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অনস্বীকার্য।

যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি: স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনসহ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পুণর্গঠনের কাজ শুরু হয়।পাকিস্তানী শোষকদের দীর্ঘ শোষণ, ব্যঞ্জনা, অন্যায়ের পর লাখো শহীদের রক্ত ও মা-বোনের মহান ত্যাগ, কোটি বাঙালির আবেগের ফসল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পরই নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন দেশ ও জাতি। ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর শেখ ফজলুল হক মণির হাত ধরে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক যুব কনভেনশনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সারাদেশে যুবশক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করে। সরকারের বিভিন্ন কর্মকান্ডকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তৎকালীন যুবলীগ সারাদেশে তাদের কর্মযজ্ঞ শুরু করে। শেখ মণির বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে খুব অল্পদিনের মধ্যেই যুবলীগ সময়োপযোগী সংগঠন হিসেবে প্রমাণিত হয়। শেখ ফজলুল হক মনির দূরদর্শী রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে যুবলীগ অল্পদিনে আওয়ামী লীগের প্রাণশক্তি হয়ে ওঠে।

বহুমাত্রিক শেখ ফজলুল হক মণি:১৯৬৩ সালেই দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার তত্ত্বাবধানে সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত হন শেখ ফজলুল হক মণি। সৃজনশীল লেখক শেখ মণি রচিত গল্পের সংকলন ‘বৃত্ত’ ১৯৬৯ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ সালে ‘গীতারায়’ নামক গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, যা ২০২০ সালে তৃতীয় মুদ্রণ বের হয়েছে। ‘গীতারায়’ গল্পগ্রন্থে মোট ৬টি গল্প আছে। গল্পগুলোর শিরোনাম হচ্ছে- বৃত্ত, ব্যর্থ, জাত, অবাঞ্ছিতা, হোঁচট এবং গীতারায়।গীতারায় বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কিত তাঁর সর্বাধিক আলোচিত ও ঐতিহাসিক সম্পাদনামূলক গ্রন্থ। তার লেখা উপন্যাস ‘অবাঞ্ছিতা’ পাঠক সমাদৃত।১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারিশেখ ফজলুল হক মণির সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বাংলার বাণী পত্রিকা প্রকাশিত হয়, যা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকাতে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট তিনি বিনোদন ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক সিনেমা’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৭৪ সালের ৭ জুন তার সম্পাদনায় দৈনিক ইংরেজী পত্রিকা ‘বাংলাদেশ টাইমস’ প্রকাশিত হয়।‘দৈনিক বাংলার বাণী ও দি বাংলাদেশ টাইমস’ পত্রিকায় একই সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায়ই সম্পাদকীয় লিখতেন তিনি।

এভাবেই পাকিস্তানিদের বর্বরতা, ধর্ষণ, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সার্বিক ফিরিস্তি তুলে ধরে বিশ্ব নজরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে উপস্থাপন করতেন দেশপ্রেমিক লেখক শেখ ফজলুল হক মণি। শেখ ফজলুল হক মনি বাংলার বাণীতে ‘দূরবীনে দূরদর্শী’ নামে কলাম লিখতেন। মৃত্যুপরবর্তী সময়ে তার লেখা কলামগুলোকে সংগ্রহ করে আগামী প্রকাশনী প্রকাশ করেছে ‘দূরবীনে দূরদর্শী’ নামক গ্রন্থ, যাতে সম্পাদনা করেছেন ফকীর আবদুর রাজ্জাক ও বিমল কর।

মেজর জেনারেল উবানের স্মৃতিচারণে শেখ মণি:১৯৭১ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা আরএডব্লিউর সাথে যুক্ত মেজর জেনারেল উবান শেখ মনি সম্বন্ধে বলেন, "উচ্চ সংস্কৃতিবান মানুষটি (শেখ মণি)কথা কম বলতেন। তাঁর হাসি বের হয়ে আসতো একদম সরাসরি হৃদয়ের ভেতর থেকে এবং সে হাসি ছিল সংক্রামক। তাঁকে হাসতে দেখে আমার ভালো লাগতো। " উবানের স্মৃতিচারণে দেখা যায়, ‘প্রচণ্ড আত্মশক্তিতে বলীয়ান এই মানুষটি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় অসুস্থ থাকতেন। কিন্তু কাজ করা বন্ধ করতেন না। অদম্য সাহসের অধিকারী এই লোকটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ ভূমিতে প্রকৃত যুদ্ধের সময় আমার সঙ্গে ছিলেন। মণির সঙ্গে সাক্ষাতে আমি বুঝেছিলাম তিনি প্রশংসনীয় গুণের অধিকারী অমিত আত্মত্যাগের মনোভাবসম্পন্ন। তাদের কেন্দ্রে প্রশিক্ষিত এক ছোট সুদর্শন বালকের ওপর অসহ্য নির্যাতন হয়েছিল।

ঢাকার পতনের পর শেখ ফজলুল হক মণি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি মুজিব বাহিনীর একটি অসুস্থ বালককে হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা নিয়ে যেতে পারেন কিনা। পরে উবান যখন ঢাকায় আসেন, তখন দেখেন শেখ মণি কম বয়সী ছেলেকে সাথে নিয়ে তার আকাশযানের দিকে আসছেন। তিনি বুঝতে দেরি করলেন না, এই সেই ছেলে যাকে শেখ মণিঢাকায় পাঠিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন। এই হলো শেখ মণি যার ধ্যানে-জ্ঞানে ছিল মনুষ্যত্ববোধ।

শেখ মণির বক্তৃতার প্রশংসা:ভারতীয় কংগ্রেসের প্রিয়রঞ্জনদাস মুন্সী ১৯৭৩ সালে বার্লিনে দশম বিশ্ব যুব সম্মেলনে শেখ মণির প্রদত্ত ইংরেজি ভাষায় রাখা বক্তব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ দিবসে শেখ শেখ মণির বক্তব্যের প্রশংসা করেন জাতিসংঘ বাংলাদেশ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহম্মদ হোসেন।১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট বাকশালের ৬৪ জেলার সম্পাদকদের প্রশিক্ষণের শেষ দিনের মূল বক্তা ছিলেন শেখ মণির বক্তৃতা নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফরহাদ মন্তব্য করেন- “আমার জীবনে এমন চমৎকার বক্তৃতা আর শুনিনি।’

বাকশাল ও শেখ ফজলুল হক মণি: বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং ১৫ সদস্যবিশিষ্ট সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান হন বঙ্গবন্ধু এবং এর ৩ জন সেক্রেটারি ছিলেন- জিল্লুর রহমান, শেখ মণি ও আবদুর রাজ্জাক। জাতীয় কৃষক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় যুবলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ- এই চারটি অঙ্গ সংগঠন গঠিত হয়।

১৪ আগস্ট ১৯৭৫ ছিল বৃহস্পতিবার। নতুন ব্যবস্থায় দেশের প্রতি মহকুমাকে জেলা ঘোষণা করে ৬৪ জেলায় একজন করে বাকশালের সম্পাদক এবং একজন করে গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। বেইলি রোডের একটি বাড়িতে ৬৪ জেলার সম্পাদকদের প্রশিক্ষণের শেষ দিন ছিল ১৪ আগস্ট। ওইদিন মূল বক্তা ছিলেন শেখ মণি। বাকশালের নীতি-আদর্শ ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে শেখ মণি প্রায় দেড় ঘণ্টার এক অনবদ্য ও জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দেন। বক্তৃতা শেষে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফরহাদ মন্তব্য করেন- “আমার জীবনে এমন চমৎকার বক্তৃতা আর শুনিনি।”

১৫ আগস্ট ১৯৭৫:১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে ঘাতকের দল প্রথমেই শেখ ফজলুল হক মণির বাসায় হামলা চালিয়ে শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্ত:সত্তা স্ত্রী আরজু মণি সেরনিয়াবাতকে হত্যা করে। ঘাতকের দল ধানমন্ডির বাসভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব,বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।‌ পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছেলে আরিফ ও সুকান্তবাবু, মেয়ে বেবি‌ এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।

এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।আগস্টের সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বিবরণীর স্মৃতিকথায় শেখ ফজলুল হক মণি ও আরজু মণি সেরনিয়াবাত এর জ্যেষ্ঠপুত্র বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের বর্তমান চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ তাঁর লেখা ‘নির্বাসনের দিনগুলি’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনায় উল্লেখ করেন-‘‘আমার মা মনে হয় বাবাকে অনেক বেশি ভালোবাসতেন। তাই প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই মা বাবার সামনে মানবঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। সেই মুহূর্তে তিনি আমাদের কথাও ভাবেন নাই। মা স্বামীর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার উদাহরণ রেখে গেছেন। হয়তো বা গুলি লাগার পরে তাঁর আমাদের দুই ভাইয়ের কথা মনে হয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ফিরে আসার আর উপায় ছিল না। তখনই মা চাচিকে বললেন, ‘ফাতু আমাকে বাঁচাও। আমার পরশ-তাপস! ওদেরকে তুমি দেইখো।’ ওটাই বোধ হয় মার শেষ কথা।”


সিলেট প্রতিদিন / এমএ


Local Ad Space
কমেন্ট বক্স
© All rights reserved © সিলেট প্রতিদিন ২৪
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি