বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৯:০১ পূর্বাহ্ন

সিলেট মেরিন একাডেমির নৌ প্রকৌশলী হুমায়ুনের নয়ছয়

  • প্রকাশের সময় : ০৩/০২/২০২৫ ১২:০২:২৯
এই শীতে ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের
Share
59

মাসুদ আহমদ রনি : সিলেটে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির কমান্ড্যান্ট নৌ-প্রকৌশলী মো. হুমায়ুন কবির কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যা ইচ্ছা তাই করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পছন্দের লোককে সব ধরনের কাজ দিয়ে লুটপাট করছেন তিনি। এতে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তার বিরুদ্ধে উল্টো ব্যবস্থা নেওয়াসহ নানাভাবে হয়রানি করছেন।


অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়ম ভেঙে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন হুমায়ুন কবির। বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অনৈতিকভাবে ব্যবহার করাসহ নিজের স্ত্রীর নামীয় বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা আদায় করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০২৩ সালে এ প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর থেকে তিনি এমন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।


সম্প্রতি সিলেট মেরিন একাডেমির এই কমান্ড্যান্টের বিরুদ্ধে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য ও নথিপত্র হাতে পেয়েছে সিলেট প্রতিদিন।


এর মধ্যে একটি নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নৌ-প্রকৌশলী মো. হুমায়ুন কবির স্বাক্ষরিত পত্রে সিলেট মেরিন একাডেমির জন্য চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি একটি দরপত্র আহ্বান করা হয়। উন্মুক্ত টেন্ডার পদ্ধতির এই দরপত্রটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১২ জানুয়ারি বা তার আগে প্রকাশিত এই দরপত্র বিক্রি করা হয় ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং তা জমা দেওয়া হয় পরের দিন অর্থাৎ ২৭ জানুয়ারি সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে। পরে সেটি উন্মুক্ত করা হয়। অভিযোগ রয়েছে- পছন্দের লোককে কাজ দিতেই এই স্বল্প সময়ে টেন্ডার জমার ব্যবস্থা করা হয়। উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় শেষমেশ নৌ-প্রকৌশলীর পছন্দের ব্যক্তিরা কাজ পান বলেও গুঞ্জন রয়েছে।


আহ্বানকৃত দরপত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্র প্রাপ্তি সাপেক্ষে যেসব কাজ করার কথা রয়েছে এর মধ্যে ১১ নম্বর স্লটে উল্লেখ রয়েছে একটি লাইট হাউস নির্মাণের। কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায় সেই লাইট হাউস দৃশ্যমান রয়েছে মেরিন একাডেমিতে। মূল ফটকের প্রবেশদ্বারের বাম পাশে বিশালাকৃতির এই লাইট হাউসটি নির্মাণাধীন থাকলেও সেটি সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে দরপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিসমিল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য এই কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি বহিরাগত হলেও চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সুপারভাইজারসহ কিছু লোক মেরিন একাডেমিতে সার্বক্ষণিক অবস্থান করেন বলেও সত্যতা মিলেছে।


লাইট হাউসের বিষয়ে ও মেরিন একাডেমিতে অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে বিসমিল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সুপারভাইজার এসকে সাদিক সিলেট প্রতিদিনকে বলেন, এটি আমার প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছে।


নির্মাণকৃত লাইট হাউস কীভাবে দরপত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এইগুলো নৌ-প্রকৌশলী স্যারের বিষয়। এই রকম আগেও হয়েছে। আর আমরা কাজ কর্ম এই মেরিন একাডেমিতে থেকে করি। 


কর্ণফুলী ট্রেডার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠান সিলেট মেরিন একাডেমিকে মাসিক ভাড়া চুক্তির বিনিময়ে দুটি গাড়ি সরবরাহ করে। লক্ষাধিক টাকা ভাড়ায় একটি মাইক্রোবাস ও একটি বিলাসবহুল জিপ গাড়ি সরবরাহ করে এই প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মাইক্রোবাসটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যবহার করা হয়। আর বিলাসবহুল জিপটি ব্যবহার করেন কমান্ড্যান্ট নিজেই। চট্ট মেট্রো-ঘ ১১-৫৮৬৯ নম্বরের বিলাসবহুল জিপটি মাসিক ৭০ হাজার টাকা ভাড়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়।


অভিযোগ রয়েছে, হুমায়ুন কবির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে নিজের গাড়িটি দিয়ে গত কয়েক মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারি কোষাগার থেকে।


এ বিষয়ে কথা হয় গাড়ি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী ময়নুল ইসলামের সাথে। সাংবাদিক পরিচয়ে গাড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান।


পরবর্তীতে তিনি সিলেট প্রতিদিনকে বলেন, আমরা দুটি গাড়ি সিলেট মেরিন একাডেমিকে সরবরাহ করি। এর মধ্যে একটি মাইক্রোবাস ও একটি জিপ। জিপ গাড়িটির মালিক কে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি সঠিক কোনো জবাব দেননি। পরে একপর্যায়ে স্বীকার করেন গাড়ির মালিক সিলেট মেরিন একাডেমির কমান্ড্যান্টের স্ত্রী।


কমান্ড্যান্টের স্ত্রীর নামের গাড়ি কীভাবে ভাড়া দিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ম্যাডাম আমার পূর্ব পরিচিত। এখানে কাজ পাওয়ার আগে থেকে আমি উনাকে চিনি। এরপর ব্যস্ত আছেন বলে মুঠোফোনের লাইন কেটে দেন ময়নুল।


এদিকে কমান্ড্যান্টের নিজের লোক হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বেশ কিছু লোককে সম্প্রতি কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একাডেমির নিয়ম ভেঙে তাদেরকে এই পদায়ন ও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানা যায়। গত ১১ জানুয়ারি নৌ-প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির স্বাক্ষরিত একটি পত্রে দেখা যায়, মেরিন একাডেমিতে গার্ডেনারের দায়িত্বে থাকা রুহুল আমিনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সহকারী উন্নয়ন কর্মকর্তা, কম্পিউটার প্রশিক্ষক মাহফুজুর রহমানকে স্টোর ইনচার্জ ও স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নটিক্যাল প্রশিক্ষক খন্দকার রাকিব হাসানকে।


সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য নিতে চাইলে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি সিলেটের নৌ-প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির সিলেট প্রতিদিনকে বলেন, এই ধরনের প্রতিষ্ঠান চালাতে কিছু ভুলভ্রান্তি হবে। আমি ব্যক্তিস্বার্থে কিছু করিনি।


নির্মাণ করা লাইট হাউস দরপত্রে আনলেন কীভাবে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এটি করা ঠিক হয়নি। আমার ভুল হয়েছে।


তার ব্যবহার করা বিলাশবহুল জিপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি স্বীকার করেন গাড়িটি তার স্ত্রী হাসিনা বেগমের নামে। নিজের স্ত্রীর নামের গাড়ি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কীভাবে টাকা উত্তোলন করেন? এই প্রশ্রের উত্তর তিনি দিতে পারেননি। এমনকি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজনকে কীভাবে মেরিন একাডেমিতে রাখেন এই প্রশ্নেরও কোনো উত্তর দিতে পারেননি।


পরবর্তীতে এ সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য প্রতিবেদককে অনুরোধ করেন তিনি। এমনকি সিলেট প্রতিদিনের অফিসে মেরিন একাডেমির দুই শিক্ষককে পাঠিয়ে নানাভাবে ম্যানেজ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন।


বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিলেট চ্যাপ্টারের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ব্যাপারটি শুনে খুবই মর্মাহত হয়েছি। এই ধরনের কাজে যারা জড়িত তাদের বিষয়ে যেন দুদক অনুসন্ধান করে। সেই সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যারা আছেন তারা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন। 


এ বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ বলেন, আমি আপনার কাছ থেকে বিষয়টি শুনলাম। এই দরপত্র আহ্বান কমিটিতে আমাদের জেলা প্রশাসনের কেউ থাকলে আমি বিষয়টি উনাকে জানাবো। আর পুরো বিষয়টি আমি আপনার কাছ থেকে জানলাম। আমি এই বিষয়ে জেনে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।


সিলেট প্রতিদিন / এমএআর/এমএনআই


Local Ad Space
কমেন্ট বক্স
© All rights reserved © সিলেট প্রতিদিন ২৪
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি