ওবায়দুল কাদের কোথায় আছেন- দেশে, নাকি বিদেশে এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা দাবি করেছেন, তাদের সাধারণ সম্পাদক বর্তমানে ভারতে রয়েছেন।
তিনি বলছেন, ওবায়দুল কাদের ৫ আগস্টের পরও দীর্ঘদিন দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে ছিলেন। এক সপ্তাহ আগে ভারতে গেছেন তিনি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এরপর বিভিন্ন সময় দলটির অনেক নেতা দেশের বাইরে চলে গেছেন, অনেকে ধরা পড়েছেন।
তবে আওয়ামী লীগের টানা তিন বারের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদেরের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি দেশেই আছেন নাকি দেশত্যাগ করেছেন, সে বিষয়েও কোনও তথ্য নেই সরকারের কাছে।
এরই মাঝে আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ওবায়দুল কাদের বর্তমানে ভারতের আসাম রাজ্যের গৌহাটিতে অবস্থান করছেন। এক সপ্তাহ আগে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া সীমান্ত দিয়ে মেঘালয়ের তুরা এলাকায় পৌঁছেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, “বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জোরপূর্বক দেশ ত্যাগে বাধ্য করার পর দলের নেতারা নিরাপত্তার কারণেই আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন।”
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেকেই দেশত্যাগ করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দীর্ঘদিন দেশের ভেতরই আত্মগোপনে ছিলেন। এক সপ্তাহ আগে তিনি ভারতে গেছেন; বর্তমানে আসামের গৌহাটিতে অবস্থান করছেন।”
নাদেল জানান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় বেশিরভাগ নেতা কলকাতা থাকলেও ওবায়দুল কাদের ভারত সরকারের সম্মতি আদায় করে দিল্লিতে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে গত জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন শুরু হলে তা কঠোর হাতে দমন করে আওয়ামী লীগ সরকার। সরকার পতনের আগে প্রায় প্রতিদিনই বক্তব্য-বিবৃতি দিতেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
সরকারের ব্যাপক-দমন পীড়নের মুখে শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন রূপ নেয় গণআন্দোলনে। সেই আন্দোলনে কয়েকশ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা হারিয়ে এখন ছন্নছাড়া অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ।
দলটির সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের নয়া দিল্লিতে থাকলেও ঠিক কোথায়, কীভাবে আছেন, তা প্রতিবেশী দেশটির সরকার প্রকাশ করেনি।
ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা দেশ-বিদেশে অনেক নেতাকর্মীর সঙ্গে ফোনে কথা বললেও দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ওবায়দুল কাদেরের কারও সঙ্গে কথা বলার তথ্য প্রকাশ্যে আসেনি।
এদিকে গত আগস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে অভ্যুত্থানের সময় নিহতের ঘটনাগুলোতে শেখ হাসিনা-ওবায়দুল কাদেরকে গণহত্যার আসামি করে বিচারের উদ্যোগ নিয়েছে।
শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে ভারতের প্রতি আহ্বানও জানানো হচ্ছে। তবে তাতে নয়া দিল্লি কোনও সাড়া দিচ্ছে না। এনিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কেও টানাপড়েন চলছে।
আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবীর নানক ও আব্দুর রহমান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল-আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কলকাতায় বিভিন্ন হোটেল ও বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান করছেন।
সেখানে আছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সুজিত রায় নন্দী, এস এম কামাল হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসিম কুমার উকিল, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নওফেল হাসান চৌধুরী, সাবেক উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক মীর্জা আজম রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শাসম পরশ রয়েছেন কানাডায়।
আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য ওই সূত্র আরও জানিয়েছে, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান নিখিল, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেজবাউল হোসেন সাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, মাহমুদুল হাসান রিপন, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনানসহ আওয়ামী লীগ এবং দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠগুলোর কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের অনেক নেতা কলকাতায় বিভিন্ন হোটেল ও বাসা ভাড়া করে আছেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল জানান, কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের অনেক নেতাই কলকাতা, শিলং ও ত্রিপুরা রয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমরা সকলের সঙ্গেই যথাসম্ভব যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি। নিজেদের মধ্যে অনির্ধারিত বৈঠক হচ্ছে। দলের সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আমরা বর্তমান অসাংবিধানিক সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে আন্তর্জাতিকভাবে দলের অবস্থান তুলে ধরছি।”
এসময় বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে ঘরবাড়ি ছাড়া করার, হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দেওয়ার অভিযোগ করেন দলটির এই সাংগঠনিক সম্পাদক।
শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, “বিনা মামলায় কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যা, অগ্নিসংযোগ এমনকি দলের নেতাকর্মীদের পরিবারের সদস্যদেরও নির্যাতন করা হচ্ছে। এমনকি দলের সভাপতি, জাতির পিতার কন্যাকেও ট্রাইবুনালের মাধ্যমে সাজা দেওয়ার তোড়জোর শুরু করেছে। এসব আমরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কাছে তুলে ধরছি।”
সরকার পরিচালনায় ভুল-ত্রুটি থাকাটাই স্বাভাবিক মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কোটা আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে তার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। আমাদের নেত্রী আন্তর্জাতিক তদন্তের কথাও ঘোষণা করেছিলেন। এখন সবকিছু দিবালোকের মতো স্পষ্ট- সরকার পতন ও বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে আন্দোলনের নামে এসব হত্যাযঞ্জ ও ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ একদিন এসব অন্যায়ের বিচার করবে।”
দলের সাংগঠনিক কাঠামোর বিষয়ে জানতে চাইলে শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, “আওয়ামী লীগ কর্মী, সমর্থকদের দল। আমরা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। দুর্যোগ কাটিয়ে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে আমরা সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করব। এসব বিষয়ে কথাবার্তা চলছে। কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।”
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেজন্য ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়।
এরপর গত ১৭ অক্টোবর দুই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
সেই আদেশে নির্ধারিত তারিখ গত ১৮ নভেম্বর সোমবার সকালে ১৩ আসামিকে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে দুটি প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। শুনানি শেষে তাদেরকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারাগারে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এই আসামিরা হলেন- সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান, দীপু মনি, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, শাজাহান খান, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও জুনাইদ আহমেদ পলক, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক প্রধানন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী ও সালমান এফ রহমান এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলম।
গত ১৮ নভেম্বর বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল তাদের কারাগারে রাখার ওই আদেশ দেয়।
সেদিন শেখ হাসিনাসহ সব আসামির বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির’ অভিযোগও আনা হয়। সেই অভিযোগের তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
গ্রেপ্তার থাকা আরেক আসামি সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক টাঙ্গাইলে একটি মামলায় পুলিশ হেফাজতে থাকায় তাকে উপস্থিত করা হয়নি।
প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে প্রসিকিউশন থেকে ইন্টারপোলে আবেদন জানানোর পাশাপাশি এ বিষয়ে ভারতের কাছে বহিঃসমর্পণ চুক্তির আওতায় সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে আদালতকে জানান প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেখানে বিচারে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য ছিল ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’।
বিচারে গোলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। সেই সাজা খাটার সময় কারাগারেই তার মৃত্যু ঘটে। জামায়াতের সাবেক আরেক আমির নিজামীর মৃত্যুদণ্ড হয়।
গোলাম আযমের মামলার রায়ে বলা হয়েছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের কোনও ঘটনাস্থলে আসামি উপস্থিত ছিলেন, এমন প্রমাণ নেই। এখানে তার দায় সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির। কারণ এটা স্বীকৃত যে গোলাম আযম ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির ছিলেন। তিনি শান্তি কমিটির প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তাই জামায়াতের সদস্যরা প্যারামিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণসহ যেসব অপকর্ম করেছিলেন, এসব অপরাধের দায়-দায়িত্ব তার।
মতিউর রহমান নিজামীকেও বুদ্ধিজীবী হত্যায় একাত্তরে আল বদর বাহিনীর প্রধান হিসাবে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি হিসাবে দোষি সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পাওয়া তাজুল তখন জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন।