দেয়ালটা পুরো কালো। এরমাঝে তুলির আঁচড়ে লাল রঙ দিয়ে দেয়াল সাজাচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসমা উল হুসনাসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী। আগারগাঁও এলাকায় তুলি হাতে মনোযোগ দিয়ে গ্রাফিতি আঁকছিলেন তারা। কিছু সময় বাদে লাল আলোর আভায় ভেসে উঠলো আরবি হরফে ‘আল্লাহ্’ লেখা। তিনি বলেন, এই দেশটা আমার, আমাদের। এই দেশটাকে সুন্দর করে সাজানোর দায়িত্ব আমাদের। সড়কগুলো আমরা দৃষ্টিনন্দন করতে চাই। ফুটিয়ে তুলতে চাই আমাদের কথা। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক পোস্টারেরও প্রয়োজন আছে। এর জন্য নির্দিষ্ট একটি স্থান করে দেয়া যেতে পারে।
কিন্তু যত্রতত্র রাজনৈতিক পোস্টার আমরা চাই না।
আসমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তার মা। তিনি বলেন, আমার সন্তানদের হাত ধরেই নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে। ভালো একটি কাজ করছে মেয়েরা। এ সময় তাদের পাশে থাকতে পেরে গর্ববোধ করছি। পাশেই দেখা যায় আসমার বান্ধবীরা দেয়ালে ফুটিয়ে তুলছেন। দেয়ালের এই অংশটিতে দেখা যায় তারা বৈষম্যমুক্ত, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির স্থান আদালতকে ফুটিয়ে তুলছেন।
এ যেন নতুন ঢাকা। দেয়ালগুলোতে নেই ব্যানার পোস্টারের জঞ্জাল। দেয়ালগুলো সেজে উঠেছে রঙ তুলির আঁচড়ে। শুধু ঢাকা নয় গোটা দেশের শহুরে দেয়ালগুলোই এখন রঙিন। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক পোস্টারগুলোর জায়গায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের গল্প। যে গল্পের অধ্যায়গুলোতে রয়েছে বিদ্রোহ, বেদনা, হাসি-কান্না, প্রত্যয়, দুর্নীতি, স্বপ্নসহ নানা বিষয়। যেগুলোর সিংহভাগেই রয়েছে ক’দিন আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে হয়ে যাওয়া ছাত্র-জনতার লড়াইয়ের গল্প, গণহত্যার নৃশংসতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে এই চিত্রগুলোয় গুণমুগ্ধ প্রশংসা করছেন সকলেই।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে উঠেছে দেয়ালগুলো। মিরপুর ১০ নম্বর সড়কে দেখা যায় পুরো এলাকা জুড়েই রঙের ছোঁয়া। এরমধ্যে কয়েকটি বিশেষভাবে চোখে বাধে। যাতে লেখা- ‘রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ’, ‘মানব সভ্যতা গড়বো আমরাই’, ‘দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই’, ‘বিকল্প আমরাই’। মিরপুরের মেট্রোরেলের পিলারগুলোতে বৈচিত্র্যপূর্ণ গ্রাফিতি। কয়েকটি গ্রাফিতিতে চোখ আটকে যায়, যাতে লেখা- ‘শোনো মহাজন, আমরা অনেকজন’, ‘ আমার বিচার তুমি করো, তোমার বিচার করবে কে’, ‘স্বাধীনতা ৩৬ জুলাই ২৪’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও দুটি গ্রাফিতির সামনে অনেকেই ছবি তুলছিলেন। যাতে দেশের রঙিন বেলুনের পাশে লেখা ‘এঊঘ-ত্থ, আরেকটি গ্রাফিতিতে দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তার বুকে তিনটি গুলির চিহ্ন, দু’হাতে ভাঙা শিকল, পেছনে বাংলাদেশের মানচিত্র।
এ সময় দেখা যায় একটি ছোট পিকআপে করে খাবার সরবরাহ করছিলেন কয়েকজন যুবক। কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া মেট্রো স্টেশনের মাঝামাঝি একটি পিলারে চিত্র আঁকার সময় তাদের প্যাকেট খাবার দিচ্ছিলেন। এ সময় আতিয়ার রহমান বলেন, আমরা বন্ধুরা মিলে টাকা তুলে তাদের জন্য খাবার এনেছি। তারা আমাদের দেশের জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছেন। তাদের জন্য কিছু করতে পারাটা গর্বের বিষয়।
বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী সোহানুর রহমান একটি আঁকা গ্রাফিতির উপর রঙের ছোঁয়া দিচ্ছিলেন। তিনি বলেন, আমাদের গ্রাফিতিগুলো আঁকা প্রায় শেষ। কিছু অংশে কমতি ছিল। অনেক জায়গায় রঙ উঠে গেছে। এগুলো মূলত ঠিক করার জন্যই এসেছি।
তিনি বলেন, আমরা চাই না আমাদের গ্রাফিতিগুলো হারিয়ে যাক। মানুষ জানুক আমরা কতো বড় পাথর সরিয়েছি। যে পাথর সরাতে বয়ে গেছে রক্তের বন্যা। এরপর তিনি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এই গ্রাফিতিতে লেখা ছিল, ‘করার আগে শেয়ার ভাবুন দশবার’, নিচে বড় করে লেখা- গুজবে ছারখার।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালের আকর্ষণীয় কয়েকটি গ্রাফিতি হচ্ছে- ‘সি হ্যাস মেড আস ফ্লাই’, ‘খেটে বড় হও, চেটে নয়’, ‘গর্জে ওঠো আবারো’, ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ’ এ ছাড়াও রক্তাক্ত একটি দেয়াল পাশ থেকে ছুটে আসছে গুলি। সেখানে লাশ হাতে দাঁড়িয়ে এক শিক্ষার্থী পাশে লেখা- রক্তাক্ত জুলাই ২০২৪, ‘কিলার হাসিনা’ ইত্যাদি। দুটি দেয়ালের গ্রাফিতির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন সালমান ইসলাম নামে এক পথচারী। এ দুটোতে লেখা- ভালো হয়ে যাও মাসুদ, পালাবো না প্রয়োজনে... কী জায়গা দেবেন’ আরেকটিতে লেখা- আয়নাঘর; তুমি হাকিম হইয়া হুকুম করো, পুলিশ হইয়া ধরো’।
সালমান বলেন, এই যে মুক্তভাবে ছাত্ররা ছবি আঁকছে, এই যে আমি সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি। এটা ফেসবুকেও দেবো। এটাই স্বাধীনতা। এই কাজটিই তো কতো বছর করতে পারিনি। মুক্তভাবে কথা বলতে যে কতোটা শান্তি লাগে তাতো সকলেই আমরা জানি এখন। এ ছাড়াও প্রেস ক্লাব এলাকায় গ্রাফিতিগুলোর মধ্যে অন্যতম- ‘কেউ চাঁদা চাইলে, কানের নিচে বসিয়ে দেবেন’, আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে?’, ‘স্বাধীন বাংলায় দুর্নীতির কোনো ঠাঁই নাই’, ‘বিকল্প কে? আমি তুমি আমরা’, ‘দেশ সংস্কারের কাজ চলছে’, ‘আমরা সবাই বাংলাদেশি’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট’, ‘ধন ধান্যে পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা’, ‘স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও আনবো’, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’, ওই মামা না প্লিজ’, ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি ইত্যাদি। আরেকটি ছবি ঘিরেও দেখা যায় এক পথচারীকে ছবি তুলতে। যাতে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকের ছবি ব্যঙ্গ করে আঁকা এবং লেখা- ‘স্যাটেলাইটে পানি ঢুকেছে’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা জুড়েও ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাফিতির ছোঁয়া। টিএসসি’র গেটে বিশাল করে লেখা- ‘এখন দরকার জনগণের সরকার’। ভিসি চত্বরে ছাত্রলীগের হাতে নির্মমভাবে নিপীড়নের শিকার হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নির্মমতা থেকে ছাড় পাননি নারী শিক্ষার্থীরাও। এই ভয়াল আক্রমণের চিত্র ফুটে উঠেছে গ্রাফিতিতে। আরেকটিতে ফুটে উঠেছে সারি সারি লাশের সারি। এ ছাড়াও কয়েকটি গ্রাফিতি ভাইরাল হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম- ‘গুলি করি মরে একটা, একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের একটি ভাইরাল টকশো নিয়ে গ্রাফিতি, যাতে উপস্থাপক আলোচককে বলছেন- ‘আপনি উত্তেজিত হবেন না প্লিজ’, ‘নিহত শিক্ষার্থী মুগ্ধর প্রতিচ্ছবি হাতে ‘পানি লাগবে পানি’ ‘ঘুষ চাইলেই ঘুষি’ ইত্যাদি। এ ছাড়াও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে পুরো শহর জুড়েই আঁকা হয়েছে গ্রাফিতি। সকল স্থানে তাকে খুনি, দুর্নীতিবাজ, খুনের আদেশদাতা, রক্তখেকো ইত্যাদি রূপে দেখানো হয়েছে। একটি ছবি ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে তাতে শেখ হাসিনার ব্যঙ্গাত্মক ছবির পাশে লেখা- ‘হাসিনা পালায় না’। এ ছাড়াও শহর জুড়েই চোখে বাধে নানা ধরনের আরবি ক্যালিওগ্রাফি।