ভিজিট ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে চাকরির নামে বাংলাদেশি নারী পাচারের অভিযোগ ওঠেছে। বলা হচ্ছে, এদের বিক্রি করা হয় দুবাই, শারজাহ ও আবুধাবির বিভিন্ন নাইট ক্লাবে। এরপর যৌনদাসী হিসেবে গড়ে ৩ থেকে ৪ বার বিক্রি করা হয় তাদের; চলে অকথ্য নির্যাতনও।
অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা, সন্তানের পড়াশোনা, আর সংসারের হাল ধরতে হিমশিম খাওয়া ফাতিমাকে পূর্ব পরিচিত এক নারী প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাতের রেস্তোরাঁয় ভালো বেতনে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। ঢাকা থেকে দুবাইয়ের দেইরা এলাকায় পৌঁছালে উন্মোচিত হয় উপকারীর মুখোশ। ফাতিমার গন্তব্য হয় একটি নাইট ক্লাবে।
সাড়ে ৪ মাসের নরক যন্ত্রণা শেষে নাইট ক্লাব থেকে শারজাহ ও আবুধাবিতে ফাতিমা বিক্রি হন আরও তিনবার। মাথা গোঁজার ঠাঁই ভিটে বিক্রি করে মুক্তিপণের দুই লাখ টাকা দিয়ে অবশেষে আধমরা হয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। তার ভাষ্য, তিনি বেঁচে ফিরলেও বন্দিশালায় প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে, অর্ধশত তরুণী এখনও বন্দি পাচারকারীদের হাতে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে সময় সংবাদকে ফাতিমা বলেন, ‘আমাকে দুবাইয়ের রেস্তোরাঁয় চাকরির কথা বলে পাঠানো হয়। কিন্তু গিয়ে দেখি, সেটা রেস্তোরাঁ না, ডান্স ক্লাব। কথা না শুনলে মারধর করা হতো, খাবারের সঙ্গে খাওয়ানো হত ওষুধ। আমরা একটা রুমে ২৮ জন মেয়ে ছিলাম।’
ফাতিমা বলেন, এমনভাবে শাস্তি দেয়া হয়, যেন তা দেখে অন্যরা ভয় পান। কেউ যেন পালানোর সাহস না করে, সেভাবেই তারা কঠোরভাবে আটকে রাখে।
এদিকে, আইনে ৯০ দিনে অভিযোগ গঠন এবং ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার বিধান থাকলেও আদালতে মানবপাচারের মামলা নিষ্পত্তিতে গড়ে সময় লাগছে ৩ থেকে ৫ বছর। বছরের পর বছর আদালতে চক্কর কেটে হতদরিদ্র মানুষগুলো মামলার খরচ চালাতে গিয়ে হচ্ছেন আরও নিঃস্ব। এর মধ্যে হাস্নাহেনা বেগম তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
হাস্নাহেনা বলেন, আমার দুইটা মেয়ে। তার ওপর আমার স্বামী অসুস্থ। ফলে তিনি কাজকর্ম করতে পারেন না। আমাকেই সংসার চালাতে হয়। এখন আইনজীবীকে টাকা দেবো কীভাবে, আর খাবোই বা কীভাবে! আগে শুনতাম, আইন সবার জন্য সমান। কিন্তু এখন দেখছি, সমান না!
পুলিশ সদর দফতরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট শাখার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে ভুক্তভোগীদের করা ১৪৫টি মামলা। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪৭৮টি। এমন অবস্থা উদ্বেগজনক বললেন, রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
সময় সংবাদকে তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা অবশ্যই উদ্বেগজনক। এছাড়া সঠিকভাবে সাক্ষ্য উপস্থাপন করা না গেলে আসামিরা খালাস পেয়ে যান। দ্রুততার সঙ্গে যেন বিচার হয়, মানুষ যেন সুবিচার পায়, সেটাই প্রত্যাশিত।
২০২০ সালের ২৭ মে লিবিয়ার ত্রিপলিতে মানবপাচারকারীরা ২৬ জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় ২৬টি মামলায় ১২৯ জনকে গ্রেফতার করা হলেও আজ পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েনি।
মানবপাচার সিন্ডিকেটে আছে প্রভাবশালীদের যোগসাজশ। এতে অপরাধীরা থাকছে ধরাছোয়াঁর বাইরে -- এমন অভিযোগ অভিবাসন কর্মীদের।
এ বিষয়ে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থাপক আল আমিন নয়ন সময় সংবাদকে বলেন, এটার সঙ্গে কিন্তু আমাদের দেশের অনেক প্রভাবশালী জড়িত। কুয়েতে আমাদের এক সাবেক এমপিকে মানবপাচারের অপরাধে শাস্তি দেয়া হয়েছে। তাদের ক্ষমতার কারণে আমাদের ভুক্তভোগীরা প্রকৃত ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানব পাচারসংক্রান্ত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর নাগাদ দেশের বিভিন্ন আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া ৩৩২টি মামলার মধ্যে ৩১৬টিতেই সব আসামি খালাস পেয়েছেন। অর্থাৎ, ভুক্তভোগীদের করা মামলাগুলোতে দোষীদের সাজা দেয়ার হার মাত্র ৪ শতাংশ।
২০২২ সালে ১৭ নভেম্বর আবুধাবিতে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাংলাদেশের মধ্যকার প্রথম কনস্যুলার বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মানবপাচার প্রতিরোধে সহায়তা চাওয়া হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের কাছে। তবে এখনও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি ঘটেনি। সুত্র : সময় সংবাদ