ওলীউর রহমান :: রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস’ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ইরান বিপ্লবের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খুমেনির ডাকে ১৯৭৯ সালে ইরানে সর্বপ্রথম এ দিবসটি পালন করা হয় পবিত্র আল আকসা মসজিদ মুক্তির লক্ষ্যে। এর পর থেকে মুসলিম উম্মাহ এ দিবসটি পালন করে থাকে। আল কুদস দিবসের আহবানকারী ইরানের শিয়াদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ইমাম খুমেনী হলেও বিশে^র শিয়া সুন্নী নির্বিশেষে সকল মুসলমান এ দিবসটি পালন করে থাকেন।
মুসলিমদের মধ্যে শিয়া সুন্নী মতভেদ থাকলেও পবিত্র আল আকসার সম্মান ও মর্যাদা সবার কাছে সমান এবং আল আকসার পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ। যার দরুন হামাস এবং হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ইয়াসীন হানাফী সুন্নী হলেও কট্রর শিয়া মতাদর্শী ইরান হামাসকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে থাকে। বাহরাইনের হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতীরা শিয়া মতাদর্শী হওয়া সত্ত্বেও হামাসের পক্ষে সরাসরি রণক্ষেত্রে রয়েছে। যা অন্য কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের পক্ষ্যেও সম্ভব হয় নাই।
২০২৪ সালের রমজান মাসের প্রথম সপ্তাহে হামাস, হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতী এবং ইরাকের ইসলামিক রেসিস্টেন্সের মধ্যখানে একটি বৈঠক হয়, যে বৈঠকে হামাসের প্রধান ইসমাঈল হানিয়া ও হুতীদের সর্বোচ্চ নেতা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল ইয়াহুদীবাদী ইসরাঈলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যাতে এই সংগঠনগুলো পরস্পরে সমন্বয় করতে পারে। এখান থেকেও বুঝা যায় যে, বায়তুল মোকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের আজাদীর প্রশ্নে মুসলিম উম্মাহর আদর্শিক মতভেদকে বাঁধা মনে করা হয়নি।
ইসলামের প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের কাছে ধর্মীয় কারণে পবিত্র ও সম্মানিত হলেও ইয়াহুদী খ্রিষ্টানরা শুধু ধর্মীয় কারণে নয় বরং ভৌগলিক কারণেও ফিলিস্তিনের পূর্ণ ভূ-খন্ড গ্রাস করে তাদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তারা নতুন মাত্রায় গাজা, আল-আকসা সহ সমগ্র ফিলিস্তিনে নারকীয় যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করছে। তাদের এই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে পবিত্র আল-আকসা তথা বায়তুল মোকাদ্দাসকে ভেঙ্গে সেখানে থার্ডটেম্পল নির্মাণ করা এবং তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ তালমুদের নির্দেশনা অনুযায়ী লাল গরু বলি দিয়ে তাদের শান্তির দূত দাজ্জালকে স্বাগত জানানো।
ইয়াহুদীদের এই ভয়ঙ্কর পরিকল্পনাকে প্রতিহত করার জন্য ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাস গাজা থেকে গত ৭ অক্টোবর (২০২৩ইং) ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ নামে ইসরাঈলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এক নজিরবিহীন অভিযান পরিচালনা করে। যার ফলশ্রুতিতে ইসরাঈল দীর্ঘ এক মাস গাজার উপর বিমান হামলা ও স্থল অভিযান চালিয়ে প্রায় ২৫ হাজার অধিবাসীকে হত্যা করেছে এবং পুরো গাজাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে প্রায় মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। কিন্তু হামাসের সামরিক মুখপাত্র আবু উবায়দা ঘোষণা দিয়েছেন যে, দখলদার ইসরাঈলে বিরুদ্ধে এই অভিযান কত দীর্ঘ হবে তা ইসরাঈল কল্পনাও করতে পারবে না।
মুসলমানদের কাছে বিভিন্ন কারণে পবিত্র আল-আকসা মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ। এই মসজিদ হলো ইসলাম ধর্মের প্রথম কেবলা। ইসলামের প্রাথমিক সময়ে মহানবী (সা.) এই মসজিদের দিকে মুখ করে সালাত আদায় করেছেন। এখানে দীর্ঘ দিন ওহী অবতীর্ণ হয়েছে। বিশ^নবী (সা.) এর মেরাজের স্মৃতি সহ অসংখ্য নবী ও রাসূলদের স্মৃতি বিজড়িত এই মসজিদ। বহু নবীদের সমাধি রয়েছে এর আশে পাশে। পবিত্র কুরআন এবং হাদিসে এই মসজিদের বহু ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। তাই শুধু ফিলিস্তিনের মুসলমান নয় বরং গোটা মুসলিম বিশ^ এই মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা করা এবং এই মসজিদের স্বাধীনতার লড়াইকে নিজেদের উপর ওয়াজিব মনে করেন। একারণে সময়ে সময়ে বহু রক্ত ও জীবন বিলিয়ে দিয়েছে মুসলমানগণ।
পবিত্র এ ভুমিকে কেন্দ্র করে রয়েছে দীর্ঘ ভাঙ্গা গড়ার ইতিহাস। ৬৪৮ খ্রীষ্টাব্দে হযরত ওমর (রা.) এর খেলাফতের সময় মুসলমানগণ ফিলিস্তিন ও বায়তুল মোকাদ্দাস বিজয় করেন। এর পর ১০৯৬ সালে ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু হলে ১০৯৯ সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা আল আকসা দখল করে নেয়। এর পর ১১৮৭ সালে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবী (রহ.) পুনরায় বায়তুল মোকাদ্দাসকে খ্রিষ্টানদের কবল থেকে মুক্ত করেন। এর পর সাত শত বছর পর্যন্ত ইয়াহুদী খ্রিষ্টান চক্র নানা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করেও জেরুজালেমে প্রবেশ করতে পারেনি। ১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে অনুপ্রবেশ করে এবং ১৯২০ সালে ফিলিস্তিনে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদিরা এই অন্যায় অনুপ্রবেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ফিলিস্তিন ভূমিকে ইয়াহুদী এবং মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। যার ফলে ১৯৪৮ সালে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাঈল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৭ সালে এই অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাঈল পবিত্র আল আকসাকে জবর দখল করে নেয় এবং মুসলমানদের উপর জুলুম অত্যাচার চালাতে থাকে, যা আজ অবদি অব্যাহত আছে।
ভৌগলিক দিক থেকে ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ফিলিস্তিনের পূর্বে রয়েছে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, জর্দান ও সৌদি আরব। পশ্চিমে আফ্রিকার আরব দেশ মিসর। এই পুরো অঞ্চল হলো তেলসমৃদ্ধ। আর উত্তর-পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর। যার তীরে সাইপ্রাস, তুরস্ক, গ্রিসসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশসমূহ অবস্থিত। ইউরোপ থেকে সড়কপথে আফ্রিকা যেতে হলে ফিলিস্তিনের উপর দিয়েই যেতে হবে। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা এই তিন মহাদেশের সাথে সংযুক্ত এই দেশটি পৃথিবীর মানচিত্রে এক অনন্য মর্যাদার অধিকারী। এটাই ফিলিস্তিনের ভৌগোলিক অবস্থানের একমাত্র সুবিধা নয় এবং আরও সুবিধা আছে। ফিলিস্তিন একসঙ্গে ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত। ফিলিস্তিনের দক্ষিণ অংশ ‘গালফ অব আকাবা’ বা আকাবা উপসাগরের সাথে সংযুক্ত। আকাবা উপসাগরের এক পাশে সৌদি আরব। অন্য পাশে মিসরের সিনাই উপত্যকা যা সুয়েজ খাল পর্যন্ত বিস্তৃত। ইউরোপ ও এশিয়ার বাণিজ্যক জাহাজগুলো প্রথমে লোহিত সাগরে আসে তারপর সুয়েজ খাল পার হয়ে ভূমধ্যসাগরে যায়। ইউরোপ ও এশিয়ার বাণিজ্যের মেরদন্ড সুয়েজ খাল ফিলিস্তিন থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে। সে হিসেবে সুয়েজ খালে নজর রাখা কিংবা সুয়েজ খাল বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সাইপ্রাসের চেয়েও উত্তম জায়গা হলো ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। আর জর্দান নদী ফিলিস্তিনের পূর্ব দিকে অবস্থিত। যা ফিলিস্তিন ও জর্দানের সীমান্তও।
জর্দান নদী গোলান পর্বতমালা থেকে শুরু হয়ে সি অফ গ্যালিলিতে গিয়ে পড়ে, তারপর সেখান থেকে মৃত সাগর প্রবাহিত হয়। সি অফ গ্যালিলি পানযোগ্য পানির অনেক বড় উৎস।
পৃথিবীর মানচিত্রের এই অনন্য বৈশিষ্টের অধিকারী এই দেশটির উপর পূর্ণ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে ক্রমান্বয়ে গোটা পৃথিবীতে শাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং ইয়াহুদীদের ধর্ম বিশ^াস অনুযায়ী তাদের তথাকথিত শান্তির দূত (দাজ্জাল) এসে যাতে গোটা পৃথিবীর শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারে এ লক্ষ্য সামনে রেখেই অগ্রসর হচ্ছে ইয়াহুদীবাদী ইসরাঈল। টার্গেক করেছে পবিত্র আল আকসা।