সেলিম আউয়াল : ২রা ফেব্রুয়ারি ২০২৪, চিরতরে বিদায় জানালাম সিলেটের সাংবাদিকতা জগতের এক কিংবদন্তী আবদূল ওয়াহেদ খানকে। অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘদিন, বাসায় গিয়েছি, হাসপাতালে গিয়েছি। একবার গিয়েছিলাম ৩১ মে ২০২৩ রাতে। তিন দিন ধরে হাসপাতালে, কিন্তু তিনি চোখ মেলে দেখেননি। আমি যাবার পর সৌভাগ্যবশত তাকিয়েছেন, এই তিনদিন পর এই প্রথম চোখ খুললেন। কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়েছি, আমি আর অনুজ ফয়সল (আবদুল বাতিন ফয়সল)। তাদের (পুত্র নাভিদ খান, কন্যা নুজহাত খান এবং জামাতা জুবের শাহ) ডাকে আবার ফিরে গেলাম কেবিনে। মিটি মিটি তাকাচ্ছেন। কোন কথা বলছেন না। আমি তার মুখের কাছে গিয়ে উচ্চস্বরে আমার নাম উচ্চারণ করি। আগের চেয়ে আরেকটু ভালো করে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বললেন চিনছি। তারপর আর কোন কথা নেই। আবার চোখ বুঁজলেন। ভাবলাম তার প্রিয় প্রতিষ্ঠানের নাম বলি, প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আবার বললাম মুসলিম সাহিত্য সংসদের কথা কি মনে আছে। সত্যি দারুনপ্রতিক্রিয়া হলো। এবার মুখটা আরো উজ্জ্বল করে বললেন, মনে আছে। আরো কি যেন বলতে চাইলেন, বলতে পারলেন না। আবার চোখ বুঁজলেন। কিছুক্ষণ পর আবার তার সম্পাদিত পত্রিকা দৈনিক জালালাবাদী, সাপ্তাহিক সিলেট সমাচারের কথা বললাম, এবার আর কথা বলতে পারলেন না। একটু তাকিয়ে চোখ বুঁজলেন। আর কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ পর বিদায় নিলাম, কিন্তু কিচ্ছু বললেন না। আসলে আর কথা বলতে পারছিলেন না বুঝতে পারছিলাম। আমরা বেরিয়ে আসছিলাম তিনি অপলক চোখে চেয়ে রইলেন।
আবদুল ওয়াহেদ খানকে চিনি আমাদের সেই শৈশব থেকে। আমাকে বলা হলো অফিসটার মধ্যে সবচে’ সুন্দর সুরতের যে মানুষটি তার হাতেই প্রেসরিলিজ দিয়ে আসবে। তখন সিলেট সমাচার আর দৈনিক জালালাবাদীর অফিস তাঁতিপাড়ায়। অফিসে গিয়ে খুব একটা খুঁজতে হলো না, তাকে পেয়ে গেলাম। খুবসুরত, লাল টকটকে একজন মানুষ। পাতলা চামড়ার নিচের রক্তের চলাচল যেন দেখা যাচ্ছিলো। সত্যিই অফিসটির মধ্যে সবচে’ সুন্দর, ফিটফাট, নজরকাড়া মানুষ। তিনি আবদুল ওয়াহেদ খান। সাপ্তহিক সিলেট সমাচার ও দৈনিক জালালাবাদীর সম্পাদক। আমরা তখন কঁচিকাচার মেলা করতাম। সেই মেলার নিউজ নিয়ে গিয়েছিলাম। নিউজটি ছাপা হয়েছিলো কি না মনে নেই। তবে আবদুল ওয়াহেদ খানের সাথে পরিচয় হবার স্মৃতিটা এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে।
তারপর অনেকবার দেখা হয়েছে। ঘনিষ্ঠভাবে কাছাকাছি হয়েছি। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা হয়েছে। তিনি সবসময় নতুন নতুন আইডিয়া বলতে পারতেন। সেইসব বিষয় নিয়ে আলাপ হতো। একদিন গেলাম সমাচার অফিসে। পেপার কাটিংস-এর খুব সুন্দর একটি খাতা দেখালেন। আওয়ামী উলামালীগ নেতা মাওলানা ওলিউর রহমানের কর্মকান্ডের বিভিন্ন নিউজ আর ছবির খাতা। একটি ছবির কথা মনে আছে, ওয়াহেদ খান দেখিয়েছিলেন। ছবিটি হচ্ছে একটি জনসভা মঞ্চ। মাওলানা ওলিউর রহমান মঞ্চের সামনে বসে আর পেছনে বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ। ওয়াহেদ খান বললেন দেখো কতো বড়ো মাপের নেতা ছিলেন ওলিউর রহমান, আর আজ তার পরিবার দূরাবস্থার মধ্যে। আমি চেষ্টা করছি তার পরিবারকে কিভাবে সহায়তা করা যায়। বোধ হয় তিনি সহায়তা করতে পারেননি। কারণ এর কিছুদিন পরই সাপ্তাহিক সমাচার আর জালালাবাদীর অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।
সরদার আলাউদ্দিন নামে একজন অধ্যাপক সমাচারে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলো। তার একটি প্রবন্ধের একটি জায়গায় হযরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে লেখেন ‘তিনি এমন একটি গ্রন্থ রচনা করিলেন মানুষকে হাসাইয়া কাঁদাইয়া, পাগল বানাইয়া’ (নাউযুবিল্লাহ) অথচ আল কোরআন মহান আল্লাহর বাণী। আমার মনে আছে প্রবন্ধটি ছাপা হবার পর এ লেখাটির জন্যে ক্ষমা চেয়ে সমাচারের একটি বিশেষ সংখ্যা বের করে বিভিন্ন মসজিদের দেয়ালে সেটা লাগানো হয়েছিলো। সরদার আলাউদ্দিনের লেখাটি সিলেটের তাওহিদি জনতার মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই লেখার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বেশ ক’জন লোক পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। তখনই সমাচার জালালাবাদীর তাঁতীপাড়ার অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো।
গ্রন্থাগার আন্দোলনের পথিকৃৎ মুহম্মদ নূরুল হক অসুস্থ অবস্থায় জীবনের শেষ লগ্নে। তখন মুহম্মদ নূরুল হককে নিয়ে সিলেট সমাচার একটি বিশেষ সংখ্যা বের করে। বিশেষ সংখ্যাটির জন্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করা হয়। বিজ্ঞাপন থেকে আসা পঞ্চাশ হাজার টাকার পুরোটিই মুহম্মদ নূরুল হকের চিকিৎসার জন্যে তার হাতে তুলে দিয়েছিলেন আবদূল ওয়াহেদ খান। সেই সময়ে সোনার ভরি হিসেবে নিঃসন্দেহে সেই টাকাটি ছিলো একটি বড়ো অংকের টাকা। এছাড়া পত্রিকার বিজ্ঞাপনের সিলেট চেম্বারের পাঁচ হাজার ও ইন্সুরেন্স কোম্পানির ৫ হাজার টাকা আলাদাভাবে দেয়া হয়।
আবদুল ওয়াহেদ খানকে বলা যায় এন্টি এশটাবলিশমেন্ট। তিনি স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া পছন্দ করতেন না। নিজের বিশ্বাস চিন্তার উপর অটল থাকার চেষ্টা করতেন। প্রচলিত রাজনৈতিক দাঙ্গা হাঙ্গামার ধ্যান ধারনার বিরোধী ছিলেন। এজন্যে তার পত্রিকা রাজনৈতিক নেতাদের বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি খোলামেলা সমালোচনা করতো। এজন্যে তাকে বিভিন্ন সময় এর মূল্য দিতে হয়েছে। বলা যায় শেষ পর্যন্ত পথে বসতে হয়েছে। তাঁতীপাড়ায় জালালাবাদ ও সমাচার অফিস পোড়ানোর পর অফিসটি হাউজিং এস্টেটে নেয়া হয়েছিলো। তারপর দ্বিতীয়বার হাউজিং এস্টেটে তার অফিস পোড়ানো হয়েছিলো। সেই অফিস পোড়ানোর পর তিনি আর দাঁড়াতে পারেননি। সেই থেকে তার পত্রিকা বন্ধ। আনন্দ বেদনা উদ্দীপনার এক স্মৃতির ঢালি বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি দীর্ঘকাল। আমার সাথে দেখা হলেই তার স্বপ্নের কথা বলবেন। আবার সাপ্তাহিক সিলেট সমাচার বের করবেন, মিউজিয়াম করবেন আরো কতো কি। সেই স্বপ্নের কারণে তিনি দীর্ঘদিন হাউজিং এস্টেটের পাশের ফরিদবাগে দীর্ঘদিন একটি বাসা ভাড়া নিয়ে টাকা খুইয়েছেন।
চেয়ারম্যান হিসেবে আম্বরখানায় গার্লস স্কুলকে কলেজে উন্নীত করার অন্যতম উদ্যোক্তা ওয়াহেদ খান। সেই স্কুলটি এখন ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। ডিগ্রি কলেজে পরিণত হবার বিষয়টি শুধু সময়ের ব্যাপার। তিনি ছিলেন খাজাঞ্চীবাড়ি ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। সিলেটের বেশ কিছু বিশিষ্টজন স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের বিরোধিতার মুখে স্কুল প্রতিষ্ঠা সহজসাধ্য ছিলো না, কিন্তু ওয়াহেদ খান সমাচার-জালালাবাদী দিয়ে তাদের বিরোধিতার বিরোধিতা করে ইন্টারন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজ সেই স্কুলটিও এখন কলেজ। সিলেট ইংলিশ ভার্সনে লেখাপড়ায় পথিকৃৎ প্রতিষ্ঠান।
১৯৮৭-তে যখন তিনজন ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় সিলেটে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হলো। তখন সমাচার জালালাবাদীর সাহসী অবস্থান সেই ভয়াবহ অবস্থা অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। তখন সিলেট অডিটোরিয়ামে পত্রিকাটি একটি সুধী সমাবেশের আয়োজন করেছিলো। সমাচার জালালাবাদী পত্রিকাটি সবসময় সিলেট অঞ্চলে দায়িত্বশীল অভিভাবকের ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেছে।
সেই সময়টিতে সিলেট শহরে আমার দেখা দুজন মানুষ টেবিল টকে খুব পারদর্শী ছিলেন। সাবেক সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান বাবরুল হোসেন বাবুল এবং আবদুল ওয়াহেদ খান। কান পেতে তাদের গল্প শুনতে ভাল্লাগতো। বাবরুল হোসেন বাবুল পরবর্তীতে উপজেলা চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন। বাবরুল হোসেন বাবুল বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সিলেট শহরের সেলিব্রেটি রাজনীতিবিদ। তিনি যখন সভা করতেন, আঞ্চলিক ভাষায় তার বক্তব্য শোনার জন্য মানুষজন ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতো। সেই বাবরুল হোসেন বাবুলের বিরুদ্ধে সমাচারের লেখালেখি পৌরসভার অপেন সিক্রেট ছিলো প্রায় নিয়মিত ব্যাপার। সেই লেখালেখির মূল্যায়নে আমি যাবো না, লেখাটি ভিন্নখাতে চলে যাবে। কিন্তু স্বীকার করতে হবে, ওয়াহেদ খান তার বিশ্বাসে অটল, এজন্যে তার ব্যক্তি জীবনে যতো ক্ষতি আসুক মেনে নিতেন।
সাংবাদিক আমীনূর রশীদ চৌধুরী ছিলেন সিলেটের স্বার্থের ব্যাপারে একজন আপসহীন সেনানী। আর তার ঠিক পরেই সিলেটের স্বার্থ রক্ষায় সাংবাদিকতার অঙ্গনে যাকে আমীনূর রশীদের আপোসহীন উত্তরসূরী বলে মনে করি তিনি হচ্ছেন আবদুল ওয়াহেদ খান। কিছু কিছু ব্যক্তির সাথে ওয়াহেদ খানের ঔদ্ধ্যত্যপূর্ন আচরণের কথা শহরবাসী জানলেও এই খবর ক’জন রাখেন জানিনে, আমাদের মতো কৈশোরোত্তীর্ণদের সাথে ছিলো তার স্নেহসুলভ আচরণ। যখন জালালাবাদী-সমাচারের যৌবনকাল তখনো আবদুল ওয়াহেদ খানের কাছে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা শোনার সুযোগ হয়েছে। তার সমাচার ও জালালাবাদীর অফিস ছিলো সিলেটের সুধীজনের সরগরম বৈঠকখানা। ভাষাসৈনিক মুসলিম চৌধুরীকে আমি দেখেছি ওয়াহেদ খানের অফিসে বসে গল্পগুজব করতে। বেশ ক‘দিন দেখেছি দার্শণিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, ভাষাসৈনিক মতিন উদদীন আহমদকে। তখন আমি মতিন উদদীন সাহেবকে চিনতাম না। মনে আছে মুসলিম চৌধুরী সাহেবের সাথে পেন্ট-সার্ট পরা লিও টলস্টয়ের মতো দীর্ঘ দাড়ির একজন লোককে দেখে কৌতুহলী হয়েছিলাম। পরে জেনেছি তিনি, মতিন উদদীন আহমদ। তারা যখন সমাচার অফিসে বসতেন, তখন ওয়াহিদ খানকে দেখা যেতো একজন বিনীত মানুষ। অগ্রজদের প্রতি মুরব্বিদের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ, অনুজদের প্রতি তার স্নেহসুলভ আচরণের কথা বিবেকবানরা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন।
আবদুল ওয়াহেদ খানের জালালাবাদী ও সমাচার নিছক একটি প্রেসরিলিজ সর্বস্ব অথবা বিশেষ দল-মতের অন্ধ অনুগত পত্রিকা ছিলো না। এটি ছিলো একটি সাহসী পত্রিকা, পাঠকের ভাবনার তালে ভেসে যাওয়া নয়। বরং পাঠককে দিকনির্দেশনা দেবার প্রত্যয় নিয়ে চলা পত্রিকা। আবদুল ওয়াহেদ খান তার পত্রিকার স্টাফদের সাথে অত্যন্ত ভদ্র আচরণ করতেন। প্রায় প্রতি রাতে নিজে কার ড্রাইভ করে তাদেরকে বাসায় পৌছে দিতেন। একবার আমি একটি প্রেসরিলিজ নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রেসরিলিজটি হলো আমাদের সংগঠন সাইক্লোন গ্রুপের নতুন কমিটির নিউজ। তখন জালালাবাদী সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন সংগঠণের নতুন কমিটি হলে শুধু সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদকের নাম যাবে। আমি চাইছিলাম পুরো কমিটির নাম আসুক পত্রিকায়। রিপোর্টাররা সবাই ঘনিষ্ঠজন। একজন বললেন, এক কাজ করো সম্পাদকের সাথে কথা বলে নাও। আমি ওয়াহেদ খানকে বিষয়টি বলতেই বললেন, আমি কি করবো। তুমি তাদেরকে বলো তুমি যে নিয়মিত এখানে আসা যাওয়া করো এবং তাদের সাথে তোমার যে খাতির আছে সেই খাতিরেই পুরো নিউজটি ছেপে দিতে। ওয়াহিদ খান তার রিপোর্টারদেরকে অর্ডার দিলেন না, কিন্তু তাদেরকে সম্মানিত করে দিক নির্দেশনা দিয়ে দিলেন। পরে আমাদের পুরো কমিটির নিউজ ছাপা হয়েছিলো।
বিভিন্ন বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আবদুল ওয়াহেদ খানকে যেমন আলাদা একটি বৈশিষ্ট দিয়েছে, তেমনি তার এসব সিদ্ধান্ত তাকে সময় সময় বিপর্যয়ের মুখেও ফেলেছে।
বাগান করার একটি শখ ছিলো ওয়াহেদ খানের। তাঁতিপাড়ায় সমাচার অফিসের সামনের খোলা জায়গায় তিনি একটি চমৎকার বাগান গড়ে তুলেছিলেন। আবদুল ওয়াহেদ খান ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন সংসদ তার ইতিহাসের দুঃসহ কাল অতিক্রম করছিলো। সংসদের আজীবন সম্পাদক সংসদের প্রাণ পুরুষ মুহম্মদ নূরুল হক দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ইন্তেকাল করেছেন। এতোদিন যিনি প্রতিষ্ঠানটিকে সীমাবদ্ধতা সত্বেও সন্তানের মতো আকড়ে ধরে রেখেছিলেন, হঠাৎ তার ইন্তেকাল প্রতিষ্ঠানটিকে এতিমে পরিণত করে দেয়। মুহম্মদ নূরুল হকের ইন্তেকালে সৃষ্ট শূন্যতা ও স্থবিরতা কাটিয়ে উঠতে, লাইব্রেরি সম্প্রসারণ, প্রাঙ্গনে বাগান তৈরি করতে তিনি সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সাহিত্য সংসদ তাঁর হাতের ছোঁয়ায় আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে শুরু করে।
অর্থনৈতিক সংকট, তহবিল শূন্য-আয়শূণ্য প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নিয়ে ওয়াহেদ খান আমাদের চিরচেনা সংসদের চেহারা পাল্টে দিয়েছিলেন। সংসদের সামনে নতুন গেট ও গেট থেকে সংসদ ভবন পর্যন্ত দুপাশে ফুলের গাছসহ কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে গড়ে তুলে ছিলেন মনোরম বাগান। সংসদের পাঠাগার সম্প্রসারিত করেছিলেন। পাঠাগারের ঠিক মধ্যিখানে তৈরি করেছিলেন একটি মঞ্চ। সেখানে সংসদের কর্মকর্তা বসতেন। মঞ্চটা এজন্যে করেছিলেন যাতে মঞ্চে বসে কর্মকর্তারা সারা পাঠাগারের উপর নজরদারি করতে পারেন। সংসদের এধরনের আমুল পরিবর্তন তার একক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত।
আবদুল ওয়াহেদ খান শহরতলীর বারখলায় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। এটি সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ২৫নং ওয়ার্ডভূক্ত। তার পিতা আব্দুল আজিজ খান ছিলেন একজন শিক্ষক। তার মাতা মোছাম্মত রাবেয়া খাতুন। তিনি ছিলেন তাদের তৃতীয় সন্তান।
আবদুল ওয়াহেদ খান ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে ইত্তেফাকের ঢাকা অফিসে কর্মজীবন শুরু করেন এবং ১৯৭১খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত তার ইত্তেফাকজীবন অব্যাহত ছিলো। এই সময়ে তিনি ইত্তেফাক কর্মচারী ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর সিলেট ব্যুরো প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সিলেট সমাচার ও ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত দৈনিক জালালাবাদীর তিনি সত্ত্বাধিকারী ও সম্পাদক।
আব্দুল ওয়াহেদ খান জাতীয় ও স্থানীয় সমাজ উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত ছিলেন। যে সব প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি জড়িয়ে ছিলেন এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাংলাদেশ কাউন্সিলর অব এডিটরস, সিলেট প্রেসক্লাব, জেলা পরিষদ সিলেট, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদ, সদস্য বাংলাদেশ ওভারসিজ সেন্টার ট্রাস্ট, সিলেট জেলা সমাজ কল্যাণ পরিষদ, জেলা যুব উন্নয়ন বোর্ড, সিলেট ডায়াবেটিক হাসপাতাল, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, জেলা স্কাউটস কমিটি, সিলেট জেলা স্পোর্টস্ এন্ড কালচারাল ট্রাস্ট, আর্দশ মহিলা কলেজ, নছিবা খাতুন গার্লস হাইস্কুল, কায়¯তরাইল হাইস্কুল, সিলেট পৌর সমাজ সেবা প্রকল্প পরিষদ, বি,এ,ভি,এস সিলেট, সিলেট খাজাঞ্চীবাড়ী ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, সাধারণ সম্পাদক বৃহত্তর সিলেট শিক্ষা উন্নয়ন পরিবেশ, সিলেট নাগরিক কমিটি, সিলেট শহর উন্নয়ন কমিটি, সিলেট জেলা আইন শৃঙ্খলা এডভাইজারি কমিটি, চট্রগ্রাম বিভাগীয় উন্নয়ন বোর্ড, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি ব্লাড ব্যাংক বোর্ড, সদস্য কমন ওয়েল্থ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন, মেম্বার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড প্রেস ব্রিফিং সেন্টার, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ সিলেট, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, নাটাব, চেয়ারম্যান-সিলেট শিল্পী কল্যাণ তহবিল, চেয়ারম্যান ও পরিচালক-জালালাবাদ একাডেমি ট্রাস্ট, ভাইস চেয়াম্যান চট্রগ্রাম বিভাগীয় সমাজ কল্যাণ ফেডারেশন, সাধারণ সম্পাদক জালালাবাদ দুস্থ কল্যাণ ফাউন্ডেশন। তিনি ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত রেডিও বাংলাদেশ সিলেট কেন্দ্রের নিয়মিত কথক ছিলেন।
আব্দুল ওয়াহেদ খান বিভিন রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গী হয়ে ভারত সফর করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সফরসঙ্গী হয়ে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, ব্রিটেন ও জাপান সফর করেন। মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ভূটান যান প্রেসিডেন্ট হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের সাথে। আব্দুল ওয়াহেদ খান বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশ সফর করেন। বাংলাদেশ থেকে (একক সদস্য হিসাবে) মালয়েশিয়ায় কমনওয়েল্থ জার্নালিস্ট কনফারেন্স, ১৯৭৮-এ ইন্দোনেশিয়ায় পেসিফিক রিজিওনাল জার্নালিস্ট কনফারেন্স, ১৯৭৯-তে এসোসিয়েট প্রেস অব আমেরিকা কর্তৃক আয়োজিত কনফারেন্সে যোগ দেন। তিনি ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘের ৪১তম অধিবেশনের যোগদান করেন। আন্তর্জাতিক সমাজ কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত রিজিওনাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার জন্যে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর থেকে ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত সিঙ্গাপুর সফর করেন এবং চিয়াংমাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ বিভাগ ও আন্তর্জার্তিক সমাজ কল্যাণ পরিষদের উদ্যোগে ১৯৯২-৯৩ সালে হংকং, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, আমেরিকা ও থাইল্যান্ড সফর করেন।
আবদুল ওয়াহেদ খান ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনষ্টিটিউট কর্তৃক INTERNATIONAL CULTUREL DIPLOMA OF HONOR হিসেবে মনোনীত হন এবং উক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত ÔÔFIVE THOUSAND PARSONLITIES OF THE WORLD এর পঞ্চম এডিশনের অন্তর্ভূক্ত হন। তিনি ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে আমেরিকার নিউওরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ফেলোশিপ পান। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রেটবৃটেনস্থ বাংলাদেশ ন্যাশন্যাল স্টুডেন্টস্ এওয়ার্ড কর্তৃক সাংবাদিকতা ও সমাজ সেবায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি নগদ অর্থ ও সনদ পত্র লাভ করেন।
আবদুল ওয়াহেদ খানের স্ত্রী নাজনীন হক খান, এক ছেলে ও দুই মেয়ের জনক তিনি।
আবদুল ওয়াহেদ খান দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। ১লা ফেব্রুয়ারি ২০২৪ রাত ১১টা ৫০ মিনিটে সিলেটের একটি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। পরের দিন ২রা ফেব্রুয়ারি বাদ জুমা হযরত শাহজালাল রহ. মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে মসজিদ সংলগ্ন গোরস্থানের পশ্চিমদিকে দাফন করা হয়েছে। লেখক : সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক