এই পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা মৃত্যু। মানুষ না-ও জন্মাতে পারে; কিন্তু মানুষ মারা যাবে না, সে কি কখনো হয়? ছয়তলার ছাদে রেলিংয়ের ধারে যাই না। মনকে বলি, মৃত্যু যদি আসে, তাহলে যেন আসে ঘুমের মধ্যে, আমাকে না জানিয়ে। দুভাবে মৃত্যু আমার কাম্য নয়। এক. আগুনে। দুই. চাপা পড়ে।
আগুনের মৃত্যুকে বড় ভয় পাই। মারা যাওয়ার আগে, দুদণ্ডের তরে হলেও, চোখের সামনে দেখব আগুন, সেই আগুনে আমার রোম পুড়ছে, কাপড় পুড়ছে, চামড়া ঝলসে যাচ্ছে, কণ্ঠনালি পুড়ে গলে যাচ্ছে; নাহ্, মরার আগে সে ভীষণ কষ্ট। কত যন্ত্রণা, তা আমি কল্পনাও করতে পারি না।
আর মরতে চাই না কংক্রিটের নিচে বা রেলের কামরার নিচে চাপা পড়ে। অসহায় তাকিয়ে আছি, একে ডাকছি, ওকে ডাকছি, আল্লাহকে তো ডাকছি দমে দমে; চিৎকার করে, মনে মনে; কিন্তু কেউ আসছে না উদ্ধার করতে; এলেও করার কিছু নেই তাদের; অসহায়ভাবে দেখছে, চোখের সামনে একজন লোক মারা যাচ্ছে।
যাত্রীবাহী ট্রেনের যাত্রীভরা বগিতে আগুন দেওয়া হয়েছে। দুটো ছবির দিকে তাকাতে পারছি না। এক হলো একটা স্কুলব্যাগ। ছোট্ট একটা শিশুর। ট্রেনের বগির সব পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে; লোহার চেয়ার-টেবিল পুড়ে-গলে অঙ্গার। তার মধ্যে একটা প্লাস্টিকের রঙিন স্কুলব্যাগ।
শিশুটা ওই ব্যাগটা পেয়ে কত খুশি হয়েছিল। শীতের ছুটি। বার্ষিক পরীক্ষা হয়ে গেছে। ক্লাস ওয়ানের বা টুয়ের বা কেজি স্কুলের বাচ্চাটা, মাসুম বাচ্চা, নিষ্পাপ, তাই তার নাম এখন আমরা দেব মাসুম, দাদাবাড়ি যাচ্ছিল। মাসুম বলছিল, দাদাবাড়ি গিয়ে মা আমি কিন্তু পেছনের পুকুরটায় বড়শি ফেলব। কেঁচো দিয়ে পুঁটি মাছ ধরব।
মা বলেছেন, না না। কেঁচো নাড়তে হবে না। আমি তোমাকে আটা দিয়ে চারা বানিয়ে দেব।
মা, আমি কিন্তু পুঁটি মাছ ভাজা খাব।
আচ্ছা খেয়ো। ওই দেখো, ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখো। ওই যে দেখেছ, ওই যে উঁচু বিল্ডিংটা, ইনস্যুরেন্স অফিস, ওটায় তোমার বাবা কাজ করেন।
আমার বাবা তো বড় চাকরি করে! কত বড় তার অফিস। মা, দাদাবাড়ি গিয়ে আমি কিন্তু সাঁতার শিখব এবার।
না না। তোমাকে পানিতে নামতে হবে না। খুব ঠান্ডা!
ফোন এল। মা ফোন ধরলেন। মাসুমের বাবা ফোন করেছেন। শোনো, যা শীত পড়েছে। সকালে মা তো বাড়ির আঙিনায় আগুনের পালা করবেন। শর্ষের গাছ, শুকনা ডালপালা দিয়ে আগুনের নাড়া বানাবেন। মাসুম যেন ওই আগুনের পাশে না বসে। আর তুমিও সাবধানে থাকবা। গায়ের চাদর, ওড়না, আঁচল সামলে রাখবা।
মা, বাবা! আমাকে দাও। বাবাকে বলো, আমি নাড়ার আগুনে মিষ্টি আলু পুড়িয়ে খাব।
না না। বাবা, আমি আগুন ভয় পাই।
আমিও আগুন ভয় পাই, বাবা। আমি সাবধানে থাকব। বাবা, আমি তোমার অফিস বিল্ডিং দেখেছি। বাবা, আমি বড় হয়ে তোমার অফিসে চাকরি করব।
বাবা চোখ মোছেন। বাবা, তুমি আরও অনেক বড় হবে। অনেক বড়।
ঠিক তখনই আগুন। ঠিক তখনই হইচই। আগুন লেগেছে। ট্রেন থামছে না কেন। দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ল লেলিহান শিখা।
পুড়ে গেল মাসুমের নিষ্পাপতা। পুড়ে গেল একটা শিশুর সমস্ত স্বপ্ন। পুড়ে গেল একজন নারীর চোখ, মুখ, চোখের পাতা, নাকের ফুল, কানের লতি, চুলে আগুন লাগলে গন্ধ ছড়াল, চামড়া পুড়তে থাকলে চর্বি ফুটতে লাগল, চোখের মণি গলে গেল!
আচ্ছা বলুন তো! আপনাকে যদি দুটো জিনিসের একটা বেছে নিতে হয়, আপনি কোনটা বেছে নেবেন?
১. ক্ষমতা।
২. আগুন লাগিয়ে দিয়ে শিশু ও নারী হত্যা।
যেকোনো একটা বেছে নিতেই হবে। কোনটা নেবেন? আমি জানি, আপনি বলবেন, এ দুটোর একটাও নেব না। শিশু-নারী হত্যা করে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকা আমি চাই না। ক্ষমতায় যাওয়ার বা ক্ষমতায় থাকার জন্য এর বিকল্প যত পথ আছে, আমি তার সন্ধান করব।
আপনি তা-ই বলবেন। আমি তা-ই বলব। ১৭ কোটি মানুষ সবাই তা-ই বলবে। তবু কেন আগুন লাগিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। কেন?
জানি, আমার কথা কেউ শুনবে না। তবু আমি দুটো কথা বলব।
১. পলিটিকস ইজ দ্য আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। মীমাংসা করুন। শত্রুর সঙ্গেই মীমাংসা করতে হয়। নেলসন ম্যান্ডেলা বসেছেন তাঁর নিপীড়কদের সঙ্গে, শত্রুর সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, তাঁর ভাষায়, জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছেন—একটা ফয়সালায় আসতে। সব বড় মানুষ, বড় নেতা, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করাকেই শ্রেয় বলে মেনে নিয়েছিলেন।
২. গান্ধী ছবিটা দেখে একটা জিনিস অন্তত শেখা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসক জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে গান্ধী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মার খেয়েছেন। একবারও বলেননি, আক্রমণ করো। মারো। আন্দোলন করতে হলে নিজেকে বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকুন। হাজার হাজার মানুষ, না হলে শত শত মানুষ গিয়ে রেললাইনের ওপরে দাঁড়ান। বলুন, আজ হরতাল, আজ ট্রেন চলবে না। কিন্তু নিজের ওপরে আঘাত না নিয়ে যে শিশু বা নারী রাজনীতির ‘র’-ও বোঝে না, তার ওপরে আগুনের আঘাত করা কেন?
আমি বলছি না, এ দল দায়ী, বলছি না বি দল দায়ী, আমি বলছি না, তৃতীয় পক্ষ দায়ী। আমি বলছি, এ দল, বি দল, তৃতীয় পক্ষ মিলে সমঝোতা করুন। মীমাংসা করুন। দাবি আদায়ের ন্যায়সংগত আন্দোলন চলুক। কিন্তু নিজেরা সমবেত হোন, অনশন করুন, ধরনা দিন; অন্যের ওপরে যেন আঘাত না আসে।
মোবাইল ফোনে ধারণ করা এই শিশুর ছবি আমি সহ্য করতে পারছি না।