ভালোবাসার সম্পর্কে বিশ্বাস ভাঙার স্বভাবটা মানুষের জন্মগত। স্বামী ঠকাচ্ছেন স্ত্রীকে; স্ত্রী ঠকাচ্ছেন স্বামীকে। প্রেমিক ধোঁকা দিচ্ছেন প্রেমিকাকে; আবার প্রেমিকাও সুযোগ বুঝে প্রেমিকের কাছ থেকে সরে যাচ্ছেন। তাঁদেরই-বা এমন কী দোষ? যুগের বাতাসেই তো বিশ্বাস ভঙ্গের গন্ধ!
তা ছাড়া প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের মধ্যে অন্যর প্রতি আকর্ষণের প্রবৃত্তি আছে। সামাজিক ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণে মানুষ এ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। মনের মানুষের যে আদল আমরা হৃদয়ে লালন করি, তার সবকিছু নির্দিষ্ট কোনো মানুষের মধ্যে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। সঙ্গীর এই অপূর্ণতা, অপ্রাপ্তির খেদ থেকেই মানুষ অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাতে সঙ্গীর প্রতি অনুভূতির রং বদলে যায়। একঘেয়েমি থেকে মুক্তি, মোহ কিংবা বৈচিত্র্যের নেশায়ও মানুষ পুরোনো সম্পর্কের পাট চুকিয়ে জড়িয়ে পড়ে নতুন সম্পর্কে। এই পালাবদলকে আমরা নেতিবাচক অর্থে বলি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’—মানে, ‘তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা?’
কিন্তু কেন এই বিশ্বাসঘাতকতা? আস্থার খুঁটি দিয়ে জুটি বাঁধার পর কেন তা খেয়ে নেয় অবিশ্বাসের ঘুণপোকা? আসুন, জেনে নিই তার কিছু কারণ-
সুখের খোঁজে
সুখ ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। স্থান, কাল, পাত্রভেদে এর স্বরূপ পাল্টায়। সান ডিয়েগোর এক থেরাপিস্টের বক্তব্য, বিবাহিত জীবনে সুখ না পেলে যে–কেউ বিশ্বাস ভাঙতে পারেন। মানে, পরকীয়া কিংবা অন্য যেকোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সে ক্ষেত্রে অন্তত ৬০ শতাংশ পুরুষ এবং ৫৫ শতাংশ নারী বিয়ের পর অন্য কারও প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। হয়তো ভাবছেন, তার একমাত্র কারণ বোধ হয় শারীরিক সম্পর্কে অতৃপ্তি? ভুল। মানসিক সুখ এমন একটা ব্যাপার, যা শরীরী সুখের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। হৃদয়ের সুখে ঘাটতি হলে মন অবচেতনভাবেই অন্য কাউকে খোঁজে!
সংসার কিংবা প্রেমে শান্তি না থাকলে মানুষ হাঁপিয়ে উঠবেই। নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই কথাটি সত্য। এখন সামাজিক বিধিনিষেধ বেশ শিথিল হয়ে আসায় একটু সুখের জন্য অনেকেই অন্য কাউকে খুঁজে থাকেন। কিংবা দুই নৌকায় পা দিয়ে চলেন। মানে, স্বামীও আছে, বয়ফ্রেন্ডও আছে। কিন্তু যে কারণে এ দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা, সেই অধরা সুখ কী মেলে?
একঘেয়েমি
প্রেমের ক্ষেত্রে এ প্রবণতা বেশি। নিয়মিত বিরতিতে মোবাইল বদলের মতো বদল ঘটে সঙ্গীর। কারণ, অনেকেই একজনে সুখী হতে পারেন না। এ ক্ষেত্রে বিশ্লেষকদের যুক্তি, যেহেতু কোনো মানুষই নিখুঁত নয়, সুতরাং কেউ ‘পারফেক্ট লাভার’ হয়ে উঠতে পারেন না। আর তাই কিছুদিন যেতে না যেতেই মনের মানুষকে একঘেয়ে মনে হয়। তখন অবচেতনভাবেই বিশ্বাস ভাঙার একটা প্রবণতা কাজ করে মনের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই স্বর্ণযুগে নতুন সঙ্গী বেছে নেওয়াও বেশ সহজ। একই ছাদের তলে বসবাস করছেন, অথচ আপনি জানতেও পারবেন না সঙ্গী আপনারই পাশে বসে মোবাইলে অন্য কারও সঙ্গে হৃদয় ভাগাভাগির কথা বলছেন!
শরীর বোঝো আবেগ বোঝো না!
সম্পর্কে আবেগ থাকা ভীষণ জরুরি। বেশির ভাগ পুরুষের কাছেই আবেগের চেয়ে যুক্তির মূল্য বেশি। যুক্তিবাদী পুরুষকে তাই বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হতে হয়। আবার বেশির ভাগ নারীর কাছে যুক্তির চেয়ে আবেগের দাম বেশি। তাঁদের চোখে, ভালোবাসা মানেই তো আবেগের ঘাত-প্রতিঘাত! প্রেমে কিংবা দাম্পত্যে দুটি মন মিলিত হবে কিন্তু আবেগ থাকবে না, সেটি হতে পারে না। বিরোধটা দেখা দেয় ঠিক তখনই। সেটি মোচন করতে গিয়ে অনেকেই গোটা সম্পর্কটাই মুছে ফেলেন! মানে, আরেকজন নতুন সঙ্গী বেছে নেন।
প্রতিশোধস্পৃহা
ভালোবাসার মানুষের প্রতি যেমন টান থাকে, তেমনি অভিমানও থাকে। আর অভিমান থেকেই প্রতিশোধস্পৃহার জন্ম। দেখা যায়, পুরুষ সঙ্গীটি হয়তো আগে বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। মানে, অন্য কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। প্রতিশোধস্পৃহা থেকে তখন সেই পুরুষের সঙ্গীও অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে ফেলে নিজেকে। ভেতরে-ভেতরে প্রচণ্ড অভিমানের সৃষ্টি হলে এটা ঘটে থাকে। সে ক্ষেত্রে যে নারীটি প্রতিশোধ নিতে এ কর্ম করছে, তাঁর মর্মপীড়াও কম নয়। যদিও এখন সে রকম মানুষ বেশ কম।
ভাঙা বিশ্বাস জুড়বেন যেভাবে
যেকোনো সম্পর্কই আসলে দায়িত্ব। যাঁরা নিত্যনতুন সম্পর্কে জড়ান, তাঁরা আসলে দীর্ঘদিন একজনের দায়িত্ব নিতে ভয় পান। সম্পর্কে জড়ালে এমনিতেই কিছু দায়দায়িত্ব চলে আসে। কিছু কথা দিয়ে কথা রাখার চাপ থাকে। তা না পারলে দম আটকে আসে। ঠিক তখনই মনটা বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠতে চায়। এখান থেকে মুক্তির উপায় হলো সঙ্গীর সঙ্গে সরাসরি এ বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা। তাঁর সমস্যার জায়গাগুলো একত্রে সমাধানের চেষ্টা করা। প্রয়োজনে কিছুদিন একা থাকতে পারেন। কারণ, একা থাকলে বোঝা যায় জীবনে বিশ্বাসভাজন মানুষের কত প্রয়োজন!