মুহাম্মদ মনজুর হোসেন :: কিশোর অপরাধ প্রতিকারে ইসলামের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যম-িত। সঠিক পন্থায় শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ না হওয়ার কারণেই মূলত কিশোর অপরাধ সংঘটিত হয়। এছাড়াও যে সব কারণে এই ব্যাধির সৃষ্টি হয়, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে কিশোর অপরাধ প্রতিকার করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ইসলাম সর্বজনস্বীকৃত প্রতিরোধমূলক ও সংশোধনমূলক ব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমে তা প্রতিকার করেছে। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থায় ইসলাম বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। আর সংশোধনমূলক ব্যবস্থায় নিয়েছে বাস্তবসম্মত নানা পদক্ষেপ।
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধের উত্তম স্থান হলো পরিবার। জন্মের পর শিশু পারিবারিক পরিবেশে মাতা-পিতার সংস্পর্শে আসে। শিশুর সামাজিক জীবনের ভিত্তি পরিবারেই রচিত হয়। তাই তাদের আচার-আচরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এ জন্যই ইসলাম শৈশবকাল থেকে ঈমানের শিক্ষা, ইবাদতের অনুশীলন, ইসলামের যথার্থ জ্ঞানার্জন ও নৈতিকতা উন্নয়নের দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে পরিবারের উপরে। যাতে করে আগামী দিনের নাগরিক শিশু-কিশোররা অপরাধমুক্ত থাকতে পারে। আল্লাহ তা’আলা মুমিনদেরকে এবং তাদের পরিজনদের অপরাধমুক্ত জীবনযাপন করার মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ”হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও।”
আয়াতের তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে প্রখ্যাত মুফাফসির ইমাম কুরতুবী রহ. লিখেছেন যে, আমাদের সন্তান-সন্ততি ও পরিবার পরিজনদের ইসলামী জীবন ব্যবস্থা, সমস্ত কল্যাণকর জ্ঞান ও অপরিহার্য শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া আমাদের কর্তব্য।
অনুরূপভাবে মহানবীর স. হাদিসেও শিশু-কিশোরদের সুষ্ঠু বিকাশ ও সামাজিকীকরণে পরিবারের দায়িত্বের বিষয়টি নির্দেশিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, “প্রত্যেকেই নিজ পরিবারের লোকদের তত্ত্বাবধায়ক এবং সে নিজের অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। আর স্ত্রী তার স্বামীর সংসার ও তার সন্তানাদির অভিভাবক। তার এ দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে।” রাসূলুল্লাহ স. আরও বলেছেন, “পিতা তার নিজের সন্তানকে যা কিছু দান করেন তার মধ্যে সর্বোত্তম হলো ভাল শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ।”
বলা যায় যে, কিশোর-কিশোরীর আচরণ ও ব্যক্তিত্বের উন্নয়নে পরিবার সর্বাধিক অনুকূল পরিবেশ যোগায়। বিশেষ করে এক্ষেত্রে পিতা-মাতার ভূমিকা অপরিসীম। কেননা তারাই শিশু-কিশোরের সামনে বহির্বিশ্বের বাতায়ন প্রথম উন্মুক্ত করে দেন এবং সন্তানের অনুপম চরিত্র গঠনের কার্যকর অবদান রাখতে পারেন।
প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলতে বুঝায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে যাতে প্রথম থেকেই অপরাধ প্রবণতার সৃষ্টি না হয়, তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করা। যেসব কারণে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা দেখা দেয়, সেগুলোকে আগে থেকে দূর করাই এ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। মানবজীবন কতগুলো স্তর বা ধাপের সমষ্টি। জীবন পরিক্রমায় এই স্তর বা ধাপ অতিক্রম করে অগ্রসর হতে হয়। শিশু-কিশোরদের জীবন-প্রকৃতি বড়দের থেকে আলাদা। তাদের চাহিদা এবং বিকাশকালীন প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাও ভিন্নতর বিধায় পরিবেশ পরিস্থিতি শিকার হয়ে তারা যেন অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য যেসব কার্যকারণ অপরাধকর্মে লিপ্ত হতে তাদেরকে উৎসাহিত করে অথবা তাদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় কিংবা তাদেরকে তা করতে বাধ্য করে, সেগুলোকে চিহ্নিত করে অপরাধ সংঘটনের পূর্বেই তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেছে ইসলাম।
ঈমান: ‘ঈমান’ শব্দের অর্থ হলো বিশ্বাস করা। পরিভাষায় রাসূলুল্লাহ স. তাঁর মহান রবের থেকে যা নিয়ে এসেছেন তা মনেপ্রাণে গ্রহণ ও বিশ্বাস করাকে ঈমান বলে,যা মানবজীবনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ মানবজাতিকে ঈমানের দিকে দাওয়াত দিয়েছেন। জাগতিক জীবনের প্রকৃত শান্তি, বিশুদ্ধ জীবনযাত্রা, সামগ্রিক কল্যাণ ও পারলৌকিক উক্তি ইত্যাদি সবকিছুর সফলতা প্রকৃত অর্থে ঈমানের বিশুদ্ধতার উপরই নির্ভরশীল। ঈমান হলো সকল প্রকার অপরাধ প্রতিরোধক। অপরাধমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে ঈমানের ভূমিকা অপরিসীম। যার হৃদয় মনে ঈমান সক্রিয় ও জাগরূক থাকে সে কখনোই কুরআন-সুন্নাহর বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে অপরাধে লিপ্ত হতে পারে না। তবে ঈমান যেমন মানুষকে আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত বানায়, তেমনি কুফর বানায় শয়তানের অনুসারী। যারা নিজেদেরকে শয়তানের অনুসারীতে পরিণত করবে তারাই শয়তানের প্ররোচনায় সকল প্রকারের পাপকর্ম ও অপরাধে লিপ্ত হতে বাধ্য হবে। আল্লাহ ইমানদারদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলো না। কেননা যে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণের নীতি গ্রহণ করবে, শয়তান তাকে অশ্লীলতা ও অপরাধমূলক কর্মেরই আদেশ করবে।”
কেবল ঈমানই পারে মানুষকে খারাপ পরিণতি থেকে রক্ষা করতে। এ জন্যই শিশু-সন্তান যখন প্রথম কথা বলতে শুরু করে, তখন ঈমানের প্রশিক্ষণ হিসেবে পিতা-মাতার উচিৎ, সন্তানের মুখ দ্বারা সর্বপ্রথম আল্লাহর নাম উচ্চারণ করানো। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বলা হয়েছে, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের প্রথম কথা শুরু করবে এই বলে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই।”
একদা রাসুলুল্লাহকে স. জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কোন কাজটি সবচেয়ে উত্তম? জবাবে তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন করা। উক্ত হাদিসে ঈমানকে শ্রেষ্ঠ কর্মরূপে চিহ্নিত করার মূলে ছিল, তার সর্বোত্তম কল্যাণের ধারক হওয়া এবং যাবতীয় অন্যায় অকল্যাণ প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করা।
এছাড়াও সন্তানদেরকে আল্লাহর সৃষ্টি জগতের প্রতি আকর্ষণ করে যুক্তির মাধ্যমে আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন তথা ঈমান আনয়নের আহবান জানাতে হবে। এ বিষয়ে লুকমান হাকিমের উপদেশগুলো প্রণিধানযোগ্য। যা প্রতিটি মানবসন্তানের ঈমানকে সুদৃঢ়, কর্মকে পরিশুদ্ধ, চরিত্রকে সংশোধন ও সামাজিক শিষ্টাচারকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। আল-কুরআনে উক্ত উপদেশাবলী চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “(হে নবী, স্মরণ করো) যখন লুকমান তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বললো, হে প্রিয় বৎস! আল্লাহর সাথে শরীক করো না। নিশ্চয় শিরক গুরুতর অপরাধ।”
এভাবে অভিভাবকগণ পর্যায়ক্রমে সন্তানদের সামনে ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলো যেমন আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতা, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ এবং আখিরাতের প্রতিটি পর্যায় যেমন কবর, হাশর, জান্নাত, জাহান্নাম এবং ভাগ্যের ভাল-মন্দের পরিচয় অত্যন্ত সুন্দর ও যৌক্তিকভাবে তুলে ধরে সেগুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবেন। ফলে সন্তানের ঈমান হবে সুদৃঢ়। আর ঈমান দৃঢ় ও শিরকমুক্ত হলে নৈতিক গুণাবলী অর্জন তার জন্য অত্যন্ত সহজ হবে।
জ্ঞান মানুষের অমূল্য সম্পদ। মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই মানবিক গুণাবলী উৎকর্ষিত ও বিকশিত হয়। যে জ্ঞানের উৎকর্ষিত ও বিকশিত হয়, যে জ্ঞানের কল্যাণেই মানবজাতি সমগ্র জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন, সেটি হলো কুরআন ও হাদিসের জ্ঞান। আল-কুরআন সকল জ্ঞানের উৎস। হাদিস তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ। ইসলাম জ্ঞানার্জনকে সকল মুসলিমের জন্য আবশ্যক করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ স. বলেছেন, জ্ঞানার্জন সকল মুসলিমের উপর ফরয। বস্তুত জ্ঞানার্জন দ্বীনকে ভালভাবে উপলব্ধি করার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। দ্বীনের কল্যাণ ও উৎকর্ষ নির্ভর করে জ্ঞানার্জনের উপর। একমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তিরাই আল্লাহকে সত্যিকারার্থে ভয় করে তাঁর আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করে। যেমন আল-কুরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহর বান্দাহদের মধ্যে কেবল বিদ্বানগণই আল্লাহকে ভয় করে।”
সুতরাং মাতা-পিতা সন্তানকে ঈমানের শিক্ষা প্রদানের পর ইসলামের যথার্থ জ্ঞান দান করবেন এবং তাদের অনুসন্ধিৎসাকে জাগিয়ে তুলবেন, যাতে করে তারা অর্জিত জ্ঞানের দ্বারা ভাল-মন্দের, ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে এবং নিজেদেরকে বিরত রাখতে পারে অপরাধকর্ম থেকে।
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে ইবাদতের রয়েছে ব্যাপক প্রভাব। ইবাদত বলা হয় চূড়ান্ত বিনয় ও নম্রতা সহকারে আল্লাহর আনুগত্য করা। ব্যাপক অর্থে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন করার নামই ইবাদত। ইসলামের মৌলিক ইবাদত যথাক্রমে সালাত, সিয়াম, হজ্জ, যাকাত প্রত্যেকটিই মানুষের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া উপস্থাপন করেছে এবং প্রত্যেকটিরই চূড়ান্ত ও সর্বোচ্চ লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষকে সকল প্রকার পাপ-পঙ্কিলতা ও অপরাধ প্রবণতা থেকে মুক্ত করে কেবলমাত্র এক আল্লাহর অনুগত বান্দাহ বানানো। যেমন সালাত মহান আল্লাহর সাথে তাঁর বান্দাহদের গভীর সম্পর্ক স্থাপন ও আত্মসমর্পণের ভাবধারা সৃষ্টি করে, যা তাদেরকে অপরাধমূলক কর্মকা-ে লিপ্ত হতে বাধা দেয়। আলা-কুরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই সালাত মানুষকে যাবতীয় অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।”
সিয়াম পালনের মাধ্যমে তাকওয়ার গুণ অর্জিত হয়। যা মানব মনের যাবতীয় কুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে সাহায্য করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপরে, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।”
এভাবেই ইবাদত পালনের মাধ্যমে যাবতীয় অপরাধকর্ম থেকে বিরত থাকার মানসিকতা সৃষ্টি করতে চায় ইসলাম। মাতা-পিতা শৈশবকাল থেকেই সন্তানদের সালাত, সিয়ামসহ ইসলামের মৌলিক ইবাদত অনুশীলনের ব্যবস্থা করবেন। যাতে করে তারা কুপ্রবৃত্তি বা শয়তানের প্ররোচনায় অপরাধ কর্মে লিপ্ত না হয় এবং পরবর্তী জীবনে ইবাদত পালনে অভ্যস্ত হয়। শিশু-কিশোরদের উপর সালাত ফরয না হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ স. সন্তানদেরকে সালাত আদায়ের ব্যাপারে অভিভাবকদের নির্দেশ এবং প্রয়োজনে প্রহারের অনুমতি দিয়ে বলেন, “তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছরে পদার্পণ করলে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিবে। দশ বছর বয়সে সালাত আদায় না করলে তাদেরকে প্রহার করবে এবং তাদের জন্য আলাদা শয্যার ব্যবস্থা করবে।”
চরিত্র মানুষের উত্তম ভূষণ। মানুষের আচার-আচরণ ও দৈনন্দিন কাজ-কর্মের মধ্য দিয়ে যে স্বভাব প্রকাশিত হয় তাকে আখলাক বা চরিত্র বলে। বিশ্ববরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ইমাম গাযালী রহ. চরিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “চরিত্র হলো মানব মনে প্রোথিত এমন অবস্থা, যা থেকে কোন কর্ম চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই অনায়াসে প্রকাশিত হয়।” আর মানুষের আচার-আচরণ ও কাজ-কর্ম সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা আদর্শের আলোকে গড়ে উঠলে তাকে বলা হয় নৈতিকতা। শৈশবকাল থেকেই মূলত নৈতিকতা বিকশিত হওয়া শুরু হয় এবং কৈশোরকালের শেষ পর্যায়ে গিয়ে চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে।
শিশু-কিশোরের নৈতিকতার উন্নয়নে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাব অনস্বীকার্য। তবে পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য। মা-বাবা নৈতিকতা মেনে চললে এবং শিক্ষা দিলে শিশু-কিশোররা তা অনুকরণ করে মেনে চলতে শিখবে। এভাবে তারা চরিত্র গঠনের নৈতিক গুণাবলী অর্জন করতে পারলে কিশোর অপরাধ প্রবণতা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে সক্ষম হবে। কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত চরিত্র গঠনের উত্তম গুণাবলী যেমন তাকওয়া, লজ্জাশীলতা, সত্যবাদিতা, ওয়াদা পালন, আমানতদারিতা, সবর, ইহসান, বিনয়, নম্রতা, উদারতা ও দানশীলতা প্রভৃতি গুণাবলী পরিবারের পক্ষ থেকে সন্তানকে শিক্ষা দানের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। এ ক্ষেত্রে সন্তানকে উদ্দেশ্য করে লুকমান আ.-এর উপদেশগুলো সকল পিতা-মাতার জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে, যা আল-কুরআনে সুন্দরভাবে উল্লিখিত হয়েছে, “হে প্রিয় বৎস! সালাত কায়েম করবে, ভাল কাজের আদেশ দিবে এবং খারাপ কাজে নিষেধ করবে এবং বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করবে, এটিই তো দৃঢ় সংকল্পের কাজ। অহংকারবশত তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করবে না এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পদচারণা করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন উদ্ধত অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। তুমি পদক্ষেপ করবে সংযতভাবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করবে; নিশ্চয়ই স্বরের মধ্যে গাধার স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।”
আনাস রা. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসে রাসূলুল্লাহ স. সন্তানদেরকে শৈশবকাল থেকে শিষ্টাচার শিক্ষা প্রদানের নির্দেশ দিয়ে বলেন, “আর যখন সন্তান ছয় বছর বয়সে পদার্পণ করবে, তখন তাকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিবে।”
পিতা-মাতা সন্তানদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজ সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পন্ন করার শিক্ষা দিবেন যেমন খাবার, পানাহার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পারস্পরিক সাক্ষাৎ ও গৃহে প্রবেশের শিষ্টাচার সহ যাবতীয় আদব শিখাবেন, যা তাদের নৈতিকমান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। এ প্রসঙ্গে উমার ইবন আবী সালামাহ রা. থেকে বর্ণিত হাদিসটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “আমি শৈশবকালে রাসুলুল্লাহ স.-এর গৃহে ছিলাম। আমার হাত খাবার পাত্রের চতুর্দিকে যাচ্ছিল। তখন রাসুলুল্লাহ স. আমাকে বললেন, হে বালক! আল্লাহর নাম বলো, ডান হাতে খাও এবং নিজের সম্মুখ হতে খাও।”
এ হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শিশু-কিশোরদের সার্বিক বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। এছাড়াও শিশু যে পরিবেশে মানুষ হবে সে পরিবেশটিকে যথাসম্ভব সবদিক থেকে স্বাস্থ্যসম্মত করে তুলতে হবে। অভাব-অনটন, পারিবারিক সমস্যা, পিতা-মাতার কলহ-দ্বন্দ্ব যেন সন্তানদেরকে স্পর্শ না করে সেদিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। শিশু-কিশোরদেরকে অশ্লীল বিনোদন থেকে দূরে রাখতে সুস্থ গঠনমূলক চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে যেমন উপকারী খেলাধুলা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আনন্দ ভ্রমণ প্রভৃতি। তাদের নিত্যসঙ্গী, খেলাধুলার সাথী ও বন্ধু-বান্ধব যাতে সুনির্বাচিত হয় সেদিকে পিতা-মাতাকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা বন্ধু ভাল না হলে জীবন-জগত ও পরকাল সবই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এজন্যই ইসলাম বন্ধু নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বনের গুরুত্বারোপ করেছে।
এজন্যই মহান আল্লাহ তাঁর রাসুলুল্লাহ স.-কে ভাল লোকদের সঙ্গী হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “নিজেকে তুমি তাদেরই সংস্পর্শে রাখবে যারা সকালে ও সন্ধ্যায় আহবান কারে তাদের প্রতিপালককে তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এবং তুমি পার্থিব জীবনের শোভা কামনা করে তাদের দিক হতে তোমার দৃষ্টি ফিরে নিয়ো না; যার চিত্তকে বা অন্তরকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে তুমি তার আনুগত্য করো না”।
অনুরূপভাবে রাসুলুল্লাহ স. বলেছেন, “মানুষ তার বন্ধুর স্বভাব চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়, কাজেই তোমাদের মধ্যে যারা বন্ধু গ্রহণ করবে, তারা যেন পর্যবেক্ষণ করে তা গ্রহণ করে।”
শিশু-কিশোররা যে সমাজে বসবাস করে সে সমাজেরও রয়েছে অসংখ্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। সমাজে যদি অন্যায়-অনাচার অবাধে চলতে থাকে, তাহলে শিশু-কিশোররা তা অনুসরণ করে অপরাধ প্রবণ হতে পারে। ফলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত হওয়ার আশংকা থাকে। সমাজ থেকে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ করতে হলে কেবলমাত্র শিশু সমাজকে উন্নত করলেই চলবে না; বরং সমগ্র সমাজের উন্নয়ন করতে হবে। সমাজের নৈতিক আদর্শ, পারস্পরিক আচরণ, কর্তব্যপরায়ণতা, সামাজিক সচেতনতা প্রভৃতির মান্নোয়ন হলে স্বাভাবিকভাবেই তখন অপরাধ সমাজ থেকে লুপ্ত হয়ে যাবে। এজন্যই ইসলাম সমাজে বসবাসরত সকল মানুষের মৌলিক অধিকারে নিশ্চয়তা বিধান করেছে। সমাজের সকল সদস্যের মধ্যে সৌহার্দ-সম্প্রীতি বজায় রাখার নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, দূরবর্তী সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না।”
ইসলাম সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায়-অবিচার, অপকর্ম প্রতিরোধ করে সমাজকে স্থিতিশীল, শান্তিময় ও কল্যাণকর রাখার জন্য ভাল কাজের আদেশ ও খারাপ কাজের বাধা প্রদানের কর্মসূচি কার্যকর করার আহবান জানিয়েছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা মুসলিম সমাজকে লক্ষ্য করে বলেন, “তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল অবশ্যই হতে হবে, যারা মানুষদেরকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দিবে এবং খারাপ কাজ হতে বিরত রাখবে।”
অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমরা কল্যাণকর ও আল্লাহ ভীতির কাজে পরস্পরকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। আর পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে না।”
অনুরূপভাবে রাসুলুল্লাহ স. সমাজে অন্যায়, অপকর্ম হতে দেখলে তা প্রতিরোধের নির্দেশ দিয়ে বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ অন্যায় ও গর্হিত কাজ করতে দেখলে সে যেন তা তার হাত দিয়ে (বল প্রয়োগের মাধ্যমে) প্রতিহত করে। এতে সক্ষম না হলে সে যেন তার মুখ দিয়ে (প্রতিবাদ করে) প্রতিহত করে, তাতেও সক্ষম না হলে সে যেন তার অন্তর দিয়ে তা (অপছন্দ করে/মূলোৎপাটনের পরিকল্পনা করে) প্রতিহত করার চেষ্টা করে। আর এটি হলো ঈমানের দুর্বলতম অবস্থা।”
উল্লিখিত আয়াত ও হাদিস দ্বারা বুঝা যায় যে, সমাজের একজন সদস্য হিসেবে মু’মিনের দায়িত্ব হলো নিজে সৎকর্ম সম্পাদন করবে ও অসৎকর্ম থেকে বিরত থাকবে এবং অন্যকেও ভাল কাজে উৎসাহ দিবে ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। সমাজের বৃহত্তর পরিসরে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন, সমাজ সেবামূলক সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন ও ক্রীড়া বিষয়কে সংগঠন শিশু-কিশোরদের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রভাব সর্বাপেক্ষা বেশি।
মানবজীবনে শিক্ষা একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মহান স্রষ্টা ও সৃষ্টিজগতের পরিচয় লাভের জন্য শিক্ষাগ্রহণ আবশ্যক। আল্লাহকে চিনতে হলে এবং তাঁকে সঠিকভাবে মানতে হলে শিক্ষা লাভের বিকল্প নেই। এছাড়াও শিক্ষার মাধ্যমেই শিশু-কিশোরদের মানবিক বৃত্তিগুলো বিকশিত হয়। তাদের মেধা, মনন ও রুচি উৎকর্ষ লাভ করে এবং আচার-আচরণ হয় পরিশীলিত ও মার্জিত। পারিবারিক গ-ি পেরিয়ে শিশু-কিশোররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে এবং এখানেই তাদের শিক্ষার মূল ভিত রচিত হয়। প্রাথমিক শিক্ষায়তনে শিশু যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, পরবর্তী জীবনে তার চিন্তা-চেতনা ও আচার-আচরণে তাই প্রস্ফূটিত হয়ে উঠে। শিশু-কিশোররা তার শিক্ষক ও সহপাঠীদের কাছ থেকে যা শিখে তাই তার হৃদয়ে অঙ্কিত হয়। পারিবারিক পরিবেশে যদি এর সমর্থন মিলে তাহলে তা তার চরিত্রে প্রোথিত হয়ে যায়। অতএব, অভিভাবক যদি মনে করেন যে, নৈতিকতা সম্পন্ন করে তিনি তার সন্তানকে গড়ে তুলবেন তাহলে তাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, নিয়ম-শৃঙ্খলা, সহপাঠী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকার আচরণ; তাদের জীবন-দর্শন, তাদের সাথে সম্পর্ক, শিক্ষার বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়গুলো ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেননা এগুলো শিক্ষার্থীর আচরণ ও ব্যক্তিত্ব বিকাশে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত তাবি’ঈ মুহাম্মাদ ইব্ন সীরীন রহ. বলেছেন, “নিশ্চয়ই এই ইলম হচ্ছে দীন। সুতরাং কার নিকট থেকে দীন গ্রহণ করছ তা সতর্কতার সাথে দেখে নিবে।”
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যেখান-সেখান থেকে এবং যার তার নিকট হতে শিক্ষা গ্রহণ সমীচীন নয়। প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, পাঠ্যক্রম, শিক্ষা পদ্ধতি এবং শিক্ষকের মান কাঙ্ক্ষিত না হলে শিশু-কিশোররা বিপথগামী হতে পারে। ইসলাম জ্ঞানার্জনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে এবং শিক্ষা লাভকে সকলের মৌলিক ও অনিবার্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছে। উত্তম শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। আল-কুরআনে অনেকগুলো আয়াতে শিক্ষার বিষয়, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও শিক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আমি তোমাদের থেকেই তোমাদের কাছে একজন রাসূল পাঠিয়েছি। যিনি তোমাদেরকে আমার আয়াত পড়ে শুনান, তোমাদের জীবনকে পরিশুদ্ধ ও বিকশিত করেন তোমাদেরকে আল-কিতাব (আল-কুরআন) ও হিকমাহ (সুন্নাহ) শিক্ষা দেন। আর যা তোমরা জানানো, সেগুলো শিক্ষা দেন।”
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “(তারা) এমন কেন করলো না যে, তাদের প্রত্যেক দল থেকেই কিছু কিছু লোক বের হতো, যাতে করে তারা দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞানাশীলন করতো, অতঃপর যখন তারা নিজ নিজ জাতির কাছে ফিরে আসতো, তখন তাদের জাতিকে তারা সতর্ক করতো, যাতে করে তারা (ইসলাম বিরোধী কাজ থেকে) বিরত থাকতে পারে।”
এই আয়াতটিকে ইমাম কুরতুবী রহ. জ্ঞান শিক্ষার মৌলিক দলীল হিসেবে অভিহিত করেছেন। আলোচ্য আয়াতে ইলম শিক্ষার প্রকৃতি, পাঠ্যসূচি এবং শিক্ষা লাভের পর শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব কী হবে তা বলে দেয়া হয়েছে।
অনুরূপভাবে মানবতার জন্য কল্যাণকর ও উপকারী জ্ঞান শিক্ষা প্রদানের নির্দেশনা হাদিসেও এসেছে। রাসুলুল্লাহ স. বলেছেন, “মানুষেরা তোমাদের অনুসরণ করবে এবং দ্বীনের মর্ম জ্ঞান উপলব্ধি করার জন্য বিশ্বের দিক দিগন্ত থেকে তোমাদের কাছে ছুটে আসবে। তারা যখন তোমাদের কাছে আসবে, তোমার তাদেরকে কল্যাণকর উপদেশ (শিক্ষা) দিবে।”
অতএব, আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূলুল্লাহ স. প্রদর্শিত দিক নির্দেশনা অনুযায়ী শিশু-কিশোরদের উপযোগী কারিকুলাম বা পাঠ্যসূচি, উন্নত শিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ এবং পর্যাপ্ত শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রম নিশ্চিত করতে পারলে কিশোর-কিশোরীদের অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে রাখা যাবে এবং তারা নৈতিক মানসম্পন্ন দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত হবে।
রাষ্ট্র বা সরকার সমাজের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোন ভূখ-ের অধিবাসীরা তাদের সামাজিক জীবনের আইন-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন সাধনের জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। সরকার বিভিন্ন রকম আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে বসবাসরত নাগরিকদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চালায়। বিধায় শিশু-কিশোরদের সামাজিক বিকাশ রাষ্ট্র দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত হয়। দৈহিক ও মানসিকভাবে সুস্থ শিশু-কিশোর একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আজকের শিশু আগামী দিনে দেশ ও জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের একটি অংশ অবক্ষয়ের শিকার হয়ে অপরাধে লিপ্ত হোক এবং সমাজকে কলুষিত করুক এটি কারো কাম্য নয়। তাই কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে সরকার শিশু-কিশোরদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। যেমন সব শিশু-কিশোরের জন্য শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ অবধারিত করা এবং পাঠ্যসূচিতে নৈতিকতার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। শিশু-কিশোরদের চিত্তবিনোদনের জন্য শিশু পার্ক, শিশু সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রচার-প্রসার ও খেলার মাঠ গড়ে তোলা এবং গণমাধ্যমে অশ্লীল দৃশ্য প্রদর্শন আইন করে বন্ধ করা। অনাথ, অসহায়, প্রতিবন্ধী ও শিশু কিশোরদের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং তাদেরকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। এছাড়াও রাষ্ট্রের সার্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে সৎকাজের আদেশ দান এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে অন্যায় অপকর্ম প্রতিরোধ করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব।
উপর্যুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে রাষ্ট্র কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ করে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কল্যাণকর সমাজ বিনির্মাণ করতে পারে এবং সমাজকে রক্ষা করতে পারে যাবতীয় বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলার হাত থেকে। যা সমাজে কার্যকর করতে পারলে কিশোর অপরাধ অনেকাংশে হ্রাস পেতে পারে। সে জন্যেই ইসলাম রাষ্ট্র প্রধানদের জন্য কিছু মৌলিক কর্মসূচি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা চালু করবে, সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।”
আয়াতে সালাত কায়েমের নির্দেশের মাধ্যমে সমস্ত শারীরিক ইবাদতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অতএব, সরকার রাষ্ট্রের সকল জনগণের জন্য শারীরিক ইবাদত পালনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করবে, যাতে করে শিশু-কিশোর সহ প্রত্যেক নাগরিক নির্বিঘেœ তা আদায় করতে পারে। তেমনি যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা কার্যকর করার মাধ্যমে অনাথ, অসহায়, প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোর সহ রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করবে। সকল প্রকার সৎ ও কল্যাণকর কাজের নির্দেশ প্রদান ও বাস্তবায়ন এবং সমস্ত খারাপ ও অকল্যাণকর কাজে বাধা দান ও তা মূলোৎপাটন করা রাষ্ট্রের বিশেষ কর্তব্য।
কিশোর অপরাধ প্রবণতা দূরীকরণে বাস্তবসম্মত পদ্ধতি হলো সংশোধনমূলক ব্যবস্থা। যে সকল কিশোর-কিশোরী অল্প বয়সের কারণে এবং বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থার শিকার হয়ে অপরাধকর্মে লিপ্ত হচ্ছে, তাদের অপরাধমূলক আচরণ সংশোধনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। কল্যাণকর জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই অপরাধের সম্ভাব্য সকল পথ বন্ধ করতে শিক্ষা-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পন্থা অবলম্বন করেছে। এরপরও যদি মানবীয় দুর্বলতা ও শয়তানের প্ররোচনায় অপরাধ সংঘটিত হয়, তাহলে অপরাধের কারণ, অপরাধের মাত্রা ও বয়সের উপযুক্ততা বিবেচনায় নিয়ে শিষ্টাচারমূলক তা’যীরী শান্তি প্রয়োগ করে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের সংশোধনের ব্যবস্থা ইসলামে রয়েছে। যাতে করে তারা পরিবারের সাথে পুনরায় একত্রে মিলেমিশে থাকতে পারে এবং সমাজে পুনর্বাসিত হতে পারে।
কিশোর অপরাধের বিচার কাজ অত্যন্ত সংবেদনশীল বিধায় বয়স্কদের মতো অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করে সহানুভূতিশীল ও সংশোধনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিশোর আদালতে বিচার পরিচালনা করাই শ্রেয়। শিশু-কিশোরদের প্রতি সদয় হওয়ার নির্দেশনা মহানবীর স. হাদিসেও পরিলক্ষিত হয়। রাসুলুল্লাহ স. বলেছেন, “যে ব্যক্তি ছোটদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করে না এবং বড়দের প্রতি সম্মান দেখায় না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।”
কিশোর আদালতের উদ্দেশ্য কিশোর অপরাধের কারণ অনুসন্ধান ও শুনানি সম্পন্ন করে সংশোধন ও পুনর্বাসনের লক্ষ্য নিয়ে বিচারের রায় দেয়া। অপরাধে লিপ্ত শিশু-কিশোরদের কারাগারের অপ্রীতিকর পরিবেশ থেকে মুক্ত রেখে সামাজিক পরিবেশে আত্মশুদ্ধির সুযোগ প্রদান এবং একজন উপার্জনক্ষম ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সংশোধনী প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অপরিসীম। অপরাধীকে প্রদেয় শাস্তি স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে একজন প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে সমাজে স্বাভাবিকভাবে চলার এবং চারিত্রিক সংশোধনের আইনসম্মত সুযোগ প্রদানকে প্রবেশন বলা হয়। এ ধরনের সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে অপরাধী কিশোরদের নিয়মিত শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় শিক্ষা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং সুশৃঙ্খল জীবন যাপনে সক্ষম করে তোলা হয়।
ইসলাম শিশু-কিশোরদের দায়মুক্তি নীতি গ্রহণ করেছে। তবে সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার স্বার্থে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের অপরাধমূলক আচরণ সংশোধনের জন্য তা’যীরী বা শিষ্টাচার শিক্ষামূলক শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা ইসলামে রয়েছে, যাতে করে তারা ভবিষ্যৎ জীবনে পেশাদার অপরাধীতে পরিণত না হয় এবং তাদেরকে দেখে সমাজের অন্য শিশু-কিশোরও অপরাধকর্মে জড়িয়ে না পড়ে। তা’যীরী শাস্তি প্রদানের বিষয়টি রাসুলুল্লাহ স.-এর একটি প্রসিদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। রাসুলুল্লাহ স. বলেছেন, “তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছরে পদার্পণ করলে সালাত আদায়ের নির্দেশ দিবে। দশ বছর বয়সে সালাত আদায় না করলে তাদেরকে প্রহার করবে এবং তাদের জন্য আলাদা শয্যার ব্যবস্থা করবে।”
হুদুদ ও কিসাস পর্যায়ের কোন অপরাধ কিশোর-কিশোরীরা সংঘটন করলে তাদেরকে ইসলামী শরী’আহ নির্ধারিত দ- প্রদান করা যাবে না। কেননা তারা শরী’আতের দায়-দায়িত্ব মুক্ত হওয়ায় শাস্তিযোগ্য নয়। এ প্রসঙ্গে ‘উমার রা. থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, “অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলামে তার জন্য এবং তার উপরে আরোপিত দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে না জানবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার উপর হদ্দ, কিসাস ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা যাবে না।”
লেখক-গবেষক, কলামিস্ট