:: মাসুদ পারভেজ ::
একজন মানুষ সাধারণত ৪০ ডেসিবেল শব্দে কথা বলে।(শব্দ ডেসিবেলে মাপা হয়- সংক্ষেপে ডিবি) যাকে বলা হয়বাড়ির ভেতরের শব্দ। সেটিই কানের জন্য সুস্থ মাত্রার শব্দ। মানুষের কান ৭০ ডিবি পর্যন্ত শব্দ সহ্য করতে পারে। ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপি’র প্রতিবেদনে ঢাকায় বাণিজ্যিক এলাকায়গড়ে শব্দের মাত্রা ১১৯ এবং রাজশাহীতে ১০৩ ডিবিউল্লেখ করা হয়েছে।যা একজন মানুষের কানের সহ্য ক্ষমতার অনেক বেশি।মানুষ সাধারণত বিশ থেকে বিশ হাজার হার্জের কম বা বেশি শব্দ শুনতে পায় না। মানুষের জন্য শব্দদূষণ এ সীমার মধ্যেই হয়ে থাকে। শব্দ দূষণ এক ধরনের মারাত্মক পরিবেশ দূষণ। আমাদের সঠিক ধারনার অভাবে এ দূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে।
পরিবেশ রক্ষা আইন-১৯৯৫ এর ২০ ধারায় শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা মোতাবেক এলাকাভেদে শব্দের মাত্রা নির্দিষ্ট করে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। এতে দিন ও রাত ভেদে পাঁচটি অঞ্চলে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে যেমন- নিরিবিলি এলাকা, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা এবং মিশ্র এলাকা। গবেষণায় সর্বত্র এ মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দ পাওয়া যায়। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী সন্ধ্যা সাতটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিষিদ্ধ। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা হতে পাঁচশ মিটারের মধ্যে ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। আবার ৯ ধারা অনুসারে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে নীরব এলাকার বাইরে কোন খোলা বা আংশিক খোলা জায়গায় সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সভা বা অনুষ্ঠানে শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে।
বিধিমালার ধারা ১৭ অনুযায়ী, শব্দের মাত্রা অতিক্রম করলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যেকোন সময়ে যেকোন স্থানে প্রবেশ করে অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আটক করতে পারবেন এবং দোষী ব্যক্তিকে প্রথম বার অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারবেন এবং পুনরায় একই অপরাধ করলে অনধিক ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক দশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।
গাড়ির হর্ন শব্দদূষণের জন্য প্রধানত দায়ী থাকলেও আধুনিক জীবনে সব কর্মকাণ্ডের কারণে শব্দদূষণ সৃষ্টি হচ্ছে। সারা দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়সহ সব ক্ষেত্রে উচ্চস্বরে মাইক বাজানোর মাধ্যমে ভয়াবহ শব্দদূষণ তৈরি করা হচ্ছে। ফলে শুধু দিনের বেলায় নয়, গভীর রাত পর্যন্ত এ শব্দদূষণের শিকার হয় মানুষ। মানুষ ও প্রাণিজগতের দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপের উপর শব্দের বিরূপ প্রভাব শব্দদূষণ হিসেবে পরিচিত। শব্দদূষণ মূলত যন্ত্রপাতি, পরিবহন এবং ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে ঘটে। কলকারখানা, পরিবহন, নির্মাণকাজ, জনসমাগম, নির্বাচনি প্রচারণাসহ বিভিন্ন কাজে উচ্চ শব্দযন্ত্র ব্যবহার, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শব্দ সৃষ্টি করে কাউকে বিরক্ত করাকে শব্দদূষণ বলে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।
শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাসের পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য ও আচার-আচরণে সমস্যার সৃষ্টি হয়, স্বাভাবিক কার্যকলাপ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শব্দদূষণের কারণে দুশ্চিন্তা, উগ্রতা, উচ্চ রক্তচাপ, শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাতসহ অন্যান্য ক্ষতিকর ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য শারীরিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে স্মরণশক্তি হ্রাস, মানসিক অবসাদ তৈরি হতে পারে।
দলগতভাবে বিভিন্ন অঞ্চলে শব্দ দূষণের কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেছে-দূষণ প্রভাবিত এলাকার মানুষের মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে; আচরণে অস্বাভাবিকতা ও মানসিক উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে; মানুষকে ক্লান্ত, অবসাদগ্রস্ত ও কাজে অমনোযোগী করে তুলছে; বয়স্ক মানুষের স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে এবং এমনকি বধির হওয়ার মত খবরও পাওয়া যাচ্ছে।প্রাণীদের মধ্যে শব্দদূষণ মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে, প্রজনন এবং নেভিগেশনে প্রভাব ফেলতে পারে। কোলাহল প্রাণীর শিকারী বা শিকার সনাক্তকরণের ক্ষেত্রে ভারসাম্য পরিবর্তন করে। মানুষের ক্রিয়াকলাপের কারণে সমুদ্রের মধ্যেও শব্দদূষণ হয়। ক্রমবর্ধমান এ সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইন প্রয়োগ অপরিহার্য।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে শব্দ সচেতন করে তুলছেএবং শব্দদূষণের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করা হচ্ছে।সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শব্দ দূষণ সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার।টেলিভিশন ও রেডিওতে শব্দ জনসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে টেলিভিশন সিরিয়াল (টিভিসি) নির্মাণ ও প্রচার, আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস উদযাপন, সচেতনতামূলক উপকরণ বিতরণ, অনলাইন পোর্টাল ও সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শব্দ দূষণ ও নিয়ন্ত্রণে এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রমের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। এ কার্যক্রমের আওতায় শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা করা হচ্ছে।শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদফতর, বিআরটিএ এবং ট্রাফিক বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারকারী বা শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।শব্দদূষণের মত মারাত্মক ঘাতক থেকে জনসাধারণকে রক্ষা করতে গণমাধ্যমের পাশাপাশি অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
বৈশ্বিক পরিবেশগত সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ স্থানীয় ও আঞ্চলিক সমস্যার শিকার। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট উভয় পরিবেশগত সমস্যার মুখোমুখি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও গতিশীল নেতৃত্বে সরকার পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করছে। সরকার সংবিধানে ১৮ (ক) অনুচ্ছেদ সংযোজনের মাধ্যমে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। বিভিন্ন প্রকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে।
জনগণ ছাড়া সরকারের এককভাবে শব্দদূষণের মত একটি জটিল সামাজিক ব্যাধির সমাধান করা দুরূহ ব্যাপার। এজন্য শব্দ দূষণ আইন মেনে চলার জন্য সবাইকে অবহিত করায় সক্রিয় নাগরিকের ভূমিকা পালন করলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান, যানবাহন ও কলকারখানার শব্দ নির্দেশিত স্তরে বা নিচে বজায় রাখতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শব্দদূষণ প্রতিরোধ করা সকলের দায়িত্ব। পিআইডি ফিচার