
জননেত্রী থেকে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা
প্রকাশ ২০২৩-০৫-১৭ ১০:২২:৫৩
.jpeg6464569d0d6e8.jpeg)
মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা
আজ ১৭ মে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি,বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪৩ তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের এই দিনে দেশে ফেরেন তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। তারপর থেকেই বাংলার দুঃখী মানুষের স্বপ্নসারথি জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বভূমে ফেরার এ দিনটি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা থেকে জননেত্রী। জননেত্রী থেকে রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হতে একজন শেখ হাসিনাকে অনেক চড়াই উৎরাই আর সংকট, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে তাঁর মতো দুখী ও সফল চরিত্র আর দ্বিতীয়টি নেই, যিনি প্রায় সকল আপনজন হারিয়েও গভীর আত্মপ্রত্যয়ে একটি ভঙ্গুর দল ও একটি গুরুত্বহীন রাষ্ট্রকে আত্মমর্যাদার পরিচয় দিয়েছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়, শেখ হাসিনা তখন তার ছোট বোন শেখ রেহানা ও দুই সন্তানসহ স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। দেশের বাইরে থাকায় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম নৃশংসতা থেকে সেদিন রক্ষা পান তাঁরা। ১৫ আগস্টের বর্বরতম রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারকে শরনার্থী জীবন বেছে নিতে হয়। আশ্রয়হীন একটি নিঃস্ব পরিবারকে সেসময় অনেকেই দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন।সেদিন অসহায় এই পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন কূটনীতিক,বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের প্রয়াত স্পীকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী। পশ্চিম জার্মানি থেকেই স্ত্রী শেখ হাসিনা,শ্যালিকা শেখ রেহানা এবং শিশু পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ও শিশু কন্য সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন পরমাণু বিজ্ঞানী ডক্টর এম এ ওয়াজেদ মিয়া। ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তবে তাদের যাত্রার বিষয়টি সে সময় গোপন রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে ২৫ আগস্ট সকালে দিল্লি পৌঁছান শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান।
বিমানবন্দর থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় নয়া দিল্লির ডিফেন্স কলোনির একটি বাসায়। ওই বাসায় ছিল একটি ড্রইং-কাম-ডাইনিং রুম এবং দুটো শয়নকক্ষ।
ওই বাড়ির বাইরে না যাওয়া, সেখানকার কারো কাছে পরিচয় না দেওয়া এবং দিল্লির কারো সাথে যোগাযোগ না রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তাঁদের।
ভারতে তখন ছিল জরুরি অবস্থা। বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোনো খবরাখবর ভারতের পত্রিকায় ছাপা হতো না। সে কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে। দিল্লিতে পৌঁছানোর দুই সপ্তাহ পর ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় যান। সেখানেই শেখ হাসিনা ১৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনা অবহিত হন। এরপর শেখ হাসিনাকে ইন্ডিয়া গেইটের কাছে পান্ডারা পার্কের ‘সি' ব্লকে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য দুজন নিরাপত্তরক্ষীও দেওয়া হয়। ওয়াজেদ মিয়াকে ১৯৭৫ সালের ১ অক্টোবর ভারতের পরমাণু শক্তি বিভাগে ফেলোশিপ দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ২৪ জুলাই শেখ রেহানার বিয়ে হয় লন্ডনপ্রবাসী শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে। কিন্তু শেখ হাসিনা এবং তার স্বামী ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি।
বাংলাদেশে তখন চলছে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রায় নিষিদ্ধ। হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। হত্যাকাণ্ড আর নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা। বঙ্গবন্ধু শব্দটি উচ্চারণ করা প্রায় নিষিদ্ধ। আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া দলীয় নেতৃবৃন্দ। দলের নেতৃত্ব নিয়ে দেখা দেখা দেয় চরম টানাপোড়েন। তেমনি এক মুহুর্তে ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিভিন্ন সময় দিল্লি যান তাদের খোঁজ-খবর নিতে।
আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক কাবুল যাওয়ার সময় এবং সেখান থেকে ফেরার সময় তাঁদের সাথে দেখা করেন। আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ,জিল্লুর রহমান,সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও তৎকালীন যুবলীগ নেতা আমির হোসেন আমু দিল্লিতে যান। তাদের সফরের উদ্দেশ্য শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিতে রাজি করানো। ১৯৮০ সালের ৪ এপ্রিল শেখ হাসিনা নিজের সন্তানদের নিয়ে লন্ডনে যান শেখ রেহানার সঙ্গে দেখা করতে। যুক্তরাজ্য প্রবাসীরা শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ান সহানুভুতির হাত নিয়ে। ঐসময় লন্ডনেই তিনি প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সমাবেশ করেন এবং বিচার দাবি করেন। ১৯৮১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে থাকা অবস্থায় তিনি খবর পান, ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছে। এর এক সপ্তাহ পরে আওয়ামী লীগের সেই সময়ের শীর্ষ নেতারা দিল্লি যান।
আব্দুল মালেক উকিল,সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, আব্দুস সামাদ আজাদ, ড.কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, এম কোরবান আলী,স্বামী গোলাম আকবার চৌধুরীসহ বেগম সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, বেগম আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ১৯৮১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে দিল্লি পৌঁছান। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠক করেন তারা। এরপর ড.কামাল হোসেন ও সাজেদা চৌধুরী ছাড়া সবাই ঢাকায় চলে আসেন। ড.কামাল ও সাজেদা চৌধুরীর ওপর দায়িত্ব ছিল তাঁরা বঙ্গবন্ধু কন্যা,দলের সভাপতি শেখ হাসিনার ঢাকা ফেরার তারিখ চূড়ান্ত করবেন। তারা মার্চের দুটো সম্ভাব্য তারিখ প্রস্তাব করলেও তা নিয়ে ওয়াজেদ মিয়ার আপত্তি ছিল। ১৬ মে শেখ হাসিনা ও তাঁর মেয়ে দিল্লি থেকে একটি ফ্লাইটে কলকাতা পৌঁছান। ১৭ মে বিকেলে তাঁরা কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ ও এম কোরবান আলী। সেদিন প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে হাজার হাজার জনতা জড়ো হয়েছিলো তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরে। বিমানবন্দর থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাওয়া হয় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে, সেখানে লাখো জনতার উপস্থিতিতে এক সমাবেশে শেখ হাসিনা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন,“সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই।”
তার পর থেকেই একজন শেখ হাসিনার আনুষ্ঠানিক জননেত্রীর দায়িত্ব নিয়ে দূর্গম যাত্রা শুরু। সরকারি নিপিড়ন, নির্যাতন সহ্য করে সারাদেশ চষে বেড়ান। দলকে সংগঠিত করেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জীবনবাজী রেখে আন্দোলন সংগ্রাম করে পরিণত হন গণতন্ত্রের মানসকন্যায়। জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। ১৯৯৬ সালেএকুশ বছর পর আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন করেন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া। তারপর আবার ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কাছে পরাজিত হন।থেমে থাকেননি অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে। কারা নির্যাতন আর নির্বাসনের ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে পরবর্তীতে আবারও ২০০৮ সালে সরকার গঠন করে দেশকে কলংকমুক্ত করেন। তারপর থেকে ধারাবাহিক নেতৃত্ব দিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য গ্রহণ করেন দীর্ঘমেয়াদী দূরদর্শী পরিকল্পনা। বর্তমানে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ রূপান্তরিত হয়েছে একজন শেখ হাসিনার হাত ধরেই। বাস্তবতার সঙ্গে পথ চলতে গিয়ে অনেক সমালোচনা সহ্য করেও দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন সমৃদ্ধির পানে। বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও গেয়ে যাচ্ছেন জীবনের গান। জাতির পিতার আরাধ্য অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে জনহিতে নিবেদন করেছেন নিজেকে। বাংলাদেশকে একটি উন্নত,সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে গ্রহণ করেছেন রূপকল্প।দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে প্রায় একাই আগলে রেখেছেন প্রিয় মাতৃভূমিকে। বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করেছেন উন্নয়নশীল দেশে।
দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন সংগ্রামী জননেত্রী হিসেবে। গণতন্ত্রের মানস কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সাংবিধানিক রাজনীতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন দৃঢ়চেতা সফল নেতৃত্ব হিসেবে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন এক মর্যাদাশীল উন্নয়নকামী রাষ্ট্র। শত যড়যন্ত্র নস্যাৎ করে, ধৈর্য্য আর ত্যাগ, তিতিক্ষার পরীক্ষায় উক্তীর্ণ হয়ে আজ তিনি সফল রাষ্ট্রনায়ক।
করোনা ভাইরাস নামক বৈশ্বিক মহামারির কারণে বিশ্বের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে জিনিসপত্রের দাম গোটা বিশ্বে উর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এই কঠিন সময়েও দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়নি। তিনি আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাবে দেশ ও জাতির কল্যাণে গ্রহণ করছেন একের পর এক মানবিক কর্মসূচি। মানুষের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিতে পালন করছেন সংশপ্তকের ভূমিকা। রাষ্ট্টের অর্থনৈতিক গতিশীলতা রক্ষার্থে নিতে হচ্ছে একের পর এক কঠিন ও সাহসী সিদ্ধান্ত। বৈশ্বিক দুঃসময়ে তাঁর এবারের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হোক নতুন প্রেরণা। সুন্দর ও সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন দেখাক। আঁধার ভেদ করে আলোকিত ভোরের প্রত্যাশায় তাঁর স্বাপ্নিক পদচারণা অব্যাহত থাকুক। দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের একমাত্র অপরিহার্য পরীক্ষিত নেতৃত্ব। নির্বিঘ্ন থাকুক আধুনিক বাংলাদেশের নির্মাতা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী পথচলা। শুভ কামনা।
লেখক ; সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী।
সিলেট প্রতিদিন/ এসএল

বিজ্ঞাপন স্থান
পুরাতন সংবাদ খুঁজেন
বিজ্ঞাপন স্থান
ফেসবুক মন্তব্য