বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১:১২ অপরাহ্ন

সিলেটের ৫ শ্রেষ্ঠ নারীর সাফল্যের গল্প

  • প্রকাশের সময় : ১৯/০২/২০২৩ ০৫:৪৯:১৯
এই শীতে ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের
Share
22

শাহিনা আক্তার: জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ ২০২২ শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় পাঁচ ক্যাটাগরীতে সিলেট জেলার নির্বাচিত ৫ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতাকে সম্মানা প্রদান করা হয়েছে। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সিলেট ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবসে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে গত ৯ ডিসেম্বর শুক্রবার ৫ জন নির্বাচিত জয়িতাদের উত্তরীয়, সম্মাননা সনদ ও ক্রেস্ট প্রদান করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সিলেটের জেলা প্রশাসক মোঃ মজিবর রহমান ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সিলেটের উপ-পরিচালক শাহিনা আক্তার সহ অতিথিবৃন্দ। 

সিলেট জেলায় পাঁচ ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত জয়িতারা হলেন- অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী আছমা কামালী শান্তা, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে- অধ্যাপক ডাক্তার শামছুন্নাহার বেগম হেনা, সফল জননী- মোছাঃ ফাইমুন নেছা, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা দিলরুবা, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় বিনতা দেবী।

অর্থনৈতিকভাবে সফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ জয়িতা- আছমা কামালী শান্তা ১৯৭৫ সালের ১৯ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপজেলার মাছিহাতা ইউনিয়নের ফুলাবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

১৯৯৬ সালে দেশ বিদেশে বিউটিফিকেশনের উপর ট্রেনিং করেন এবং ব্র্যাকের সাথে বিউটিফিকেশনের উপর কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে সিলেটস্থ অঙ্গরুপা বিউটি পার্লার ইস্পা এন্ড বুটিকস পার্লার চালু করেন। তিনি নিজ অর্থায়নে সেলাই মেশিন কিনে উদ্যোক্তা তৈরিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছেন। তার প্রতিষ্ঠানে ১৫ জন মহিলা কর্মী চাকরি করছে। এখনো উদ্যোক্তা তৈরিতে তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ জয়িতা অধ্যাপক ডাঃ শামসুন্নাহার বেগম হেনা ১৯৫৮ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বুধবারীবাজার ইউনিয়নের চন্দরপুর গ্রামের জন্মগ্রহণ করেন। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসায়ের ফলে ১৯৮১ সালে এমবিবিএস, ১৯৮৮ সালে এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করে সিলেট মেডিকেল কলেজে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি সহযোগী অধ্যাপক পদ লাভ করেন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে তার চাকুরী জীবন সমাপ্ত করে ২০১৬ সালে অবসর গ্রহন করেন। 

সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে গাইনি বিষয়ে শিক্ষকতা এবং প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার পাশাপাশি সিলেটের প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। শুধু দেশেই চিকিৎসা ক্ষেত্রে সুখ্যাতি নয়, বিদেশ থেকেও তিনি পুরষ্কার লাভ করেছেন। তাঁর চিকিৎসা বিষয়ক ৩৫টি গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ডাঃ শামসুন্নাহার বেগম হেনা মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তখনকার সময়ে সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে থেমে না গিয়ে সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করায় আজ তিনি শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী জয়িতা।

সফল জননী নারী ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ জয়িতা মোছাঃ ফাইমুন নেছা ১৯৭১ সালে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার এক মেয়ে ও দুই ছেলে। তার সন্তানরা সকলেই উচ্চ শিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি নিজে  এস.এস.সি পর্যন্ত পড়াশুনা করেছেন। পারিবারিক কাজকর্ম সম্পন্ন করে সন্তানদের পড়াশুনার বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। 

প্রথম সন্তান: সকিনা আক্তার শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রথম স্থান লাভ করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট হতে স্বর্ন পদক প্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে তিনি ৩৬ তমবি.সি.এস (প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কর্মরত আছেন। দ্বিতীয় সন্তান মোঃ মুজাহিদ সিলেট মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি সিলমার্ট কোম্পানীতে কর্মরত আছেন। তৃতীয় সন্তান মোঃ বায়েজিদ ইনস্টিটিউট অফ হেলথ টেকনোলজি শাহী ঈদগাহ সিলেট থেকে ফার্মাসিতে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরিচালিত মেডিকেল সেন্টারে ফার্মাসিষ্ট পদে কর্মরত আছেন। 

নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন জীবন শুরুকারী নারী ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ জয়িতা দিলরুবা আক্তার নওঁগা জেলার নজিপুরে ১৯৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিন বোনের মধ্যে সবার বড়। ১৯৯৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ৩২ বছরের উচ্চ শিক্ষিত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সাথে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। স্বামী তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতো। ১৭ বছর বয়সে কন্যা সন্তানের মা হন। কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ায় স্বামী তাকে আরো বেশি নির্যাতন করতো। হঠাৎ স্বামী তাকে না জানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে ভরণ পোষণ ও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। 

মেয়ের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে বিউটি পার্লারে চাকুরি নেন। বিউটি পার্লারে চাকুরি এক পর্যায়ে ২০১০ সালে বাড্ডা সুবাস্ত মার্কেট আলিশা বিউটি পার্লার খুলেন। স্বামীর অপ্রচারের কারণে দোকানের মালিক তার দোকান ফিরিয়ে নেন। অবশেষে ২০১০ সালে স্বামীর সাথে বৈবাহিক বিচ্ছেদ ঘটে এবং তিনি মেয়ে নিয়ে সিলেটে চলে আসেন এবং ২০১৩ সালে মাহারুজ বিউটি পার্লার এর ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ২০১৯ সালে তিনি বিউটি পার্লার বন্ধ করে দেন। এরপর বাসায় বসে হাতের কারুকাজ শিল্প, নকশী কাথা, বিভিন্ন প্রকারের খাবার, অনলাইনে ব্যবসা এবং পার্সিয়ান বিড়ালের ব্যবসা করেন। অভিভাবকহীন নির্যাতনের বিভীষিকা থেকে নিজেকে মুক্ত করে এককভাবে স্বাবলম্বী হয়ে সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করায় আজ তিনি একজন শ্রেষ্ঠ জয়িতা।

সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় নারী ক্যাটাগরীতে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ জয়িতা বিনতা দেবী সিলেট শহরের নুরানী সুবিদবাজারে ১৯৫৯ সালের  ২১শে মে জন্মগ্রহণ করেন। পড়ালেখা শেষ করে তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরিতে প্রবেশ করেন। বিনতা দেবী একজন সৃজনশীল সমাজকর্মী ও সাদা মনের মানুষ যিনি মানবিক ও সমাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত। পাশাপাশি তিনি কবি ও গল্পকার।

বিনতা দেবী ছোট বেলা থেকেই মা-বাবাকে বলে দরিদ্র মানুষকে সাহায্যের পাশাপাশি দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের বইপত্র ও নানারকম শিক্ষা উপকরণ ক্রয় করে দিতেন। সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান, শিক্ষা সহায়ক উপকরণ দিয়ে সহযোগিতাও করে যাচ্ছেন। প্রবাসী, আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্খীদের সহযোগিতায় এবং নিজের পেনশনের টাকা থেকেও অর্থের যোগান দিয়ে শীতকালে বস্ত্র, কম্বল বিতরণ করেন। এছাড়াও নারী আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ছেলে-মেয়েদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং পড়াশুনায় আগ্রহী করে তোলার জন্য ফ্রি কোচিং সেন্টার। সারদা সংঘ সিলেটের সম্পাদক হিসেবে দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালনা। নিজস্ব লাইব্রেরি। সুবিধাবঞ্চিত নারীদের সাহায্যের জন্য ‘ডিড ইউ ডু’ কার্যক্রম। বিপন্ন মহিলাদের কর্মসংস্থান কেন্দ্র।  নারী জাগরণ ও নারীদের আত্মসচেতন করে তুলতে সারদা সংঘের মাধ্যমে মাসিক সম্মেলন পরিচালনা। সুবিধাবঞ্চিত নারীদের বিভিন্ন সামাজিক উৎসবে বস্ত্র দান, খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেন। 

সমাজের সার্বিক কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ এক নারী বিনতা দেবী এই ভোগবাদী, স্বার্থপর সমাজে বাস করেও দুঃস্থ, অসহায় মানুষের পাশে এসে যেভাবে দাঁড়িয়েছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, তা সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করায় আজ তিনি সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় নারী জয়িতা বিনতা দেবী।

লেখক: শাহিনা আক্তার, উপ-পরিচালক, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, সিলেট।


সিলেট প্রতিদিন / এমএনআই


Local Ad Space
কমেন্ট বক্স
© All rights reserved © সিলেট প্রতিদিন ২৪
পোর্টাল বাস্তবায়নে : বিডি আইটি ফ্যাক্টরি