
সুনামগঞ্জে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে কচ্ছপ গতি, শংকিত কৃষক

জামালগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশ ২০২৩-০২-০১ ০৫:০৮:৩১

তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ, জামালগঞ্জ: সুনামগঞ্জের হাওরে এবারো বোরো ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ চলছে কচ্ছপ গতিতে। এখনো অনেক বাঁধে মাটিও পড়েনি। এ কারণে দুশ্চিন্তা যেন পিছু ছাড়ছে না কৃষকদের। মহাজনি ঋণ করে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ফসল ফলান কৃষকরা। বছরে একটি মাত্র বোরো ফসলের উপর নির্ভর কৃষকদের জীবন-জীবিকা। ফসল ঘরে উঠলে আনন্দে কাটে তাদের সারা বছর। ফসল তলিয়ে গেলে অনাহারে-অর্ধাহারে কোন রকম দিন পাড় করেন পরিবার পরিজনদের নিয়ে।
হাওরে বাঁধ নির্মাণে গত বছর সুনামগঞ্জ জেলায় ৫৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে ৭২৭টি প্রকল্পে কাজ হয়েছিল। চলতি বছর সাড়ে ৫'শত কিলোমিটার বাঁধে সংস্কার কাজ হবে বলে জানা গেছ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে। কোন কোন অক্ষত বাঁধেই আবার দেয়া হয়েছে গত বছরের সমপরিমাণ বরাদ্দ এমন অভিযোগ উঠেছে বহু। তবে প্রকল্প শুরুর নির্ধারিত দিন ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে আর শেষ করতে হবে ২৮ ফেব্রুয়ারী।
কৃষকরা বলছেন, অনেক বাঁধে এখনো কোন কাজই শুরু হয়নি, যেগুলো শুরু হয়েছে এই বাঁধগুলোতে দর্মুজ করা হচ্ছে না। কিন্তু দর্মুজ করার জন্যই আলাদা বিল (টাকা) ধরা আছে প্রত্যেক বাঁধে। দর্মুজ না করায় বাঁধের গুণগত মান ভালো থাকবেনা। সামান্য বৃষ্টি বা পানির স্ত্রোস হলেই বাঁধ ধসে ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকায় হাওরের একমাত্র বোরো ফসল নিয়ে চিন্তিত কৃষকরা।
কৃষকরা জানান, আগে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ টেন্ডার প্রক্রিয়ায় হতো। এতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলা হয়। ২০১৭ সালে সুনামগঞ্জের সব ক’টি হাওরের বোরো ফসল বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে যাওয়ার পর সরকার বিশেষ কাবিটা আইন করে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ কৃষকদের নিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি-(পিআইসি)।
কৃষকদের অভিযোগ দলীয় নেতাকর্মীরা তাদের নিজেদের অনুগতদের নাম প্রকাশ করে ভিরতরে ভিতরে তারাই কাজের ভাগ বাটোয়ারা বসাচ্ছে। অতীতে যাদেরকে হাওরে বাঁধের কাজে দেখা যায়নি, এমন অনেক নেতাকর্মীরা পিআইসি প্রথা চালু হওয়ার পর বাঁধে ফটো সেশন (সেলফি তুলে) করে পরিদর্শনের ভাব দেখিয়ে নিজেদের শেয়ার থাকা কাজগুলো দেখে আসে। তারাই পাউবো অফিসে সর্বক্ষণ পিআইসির টাকা (বিল) উত্তোলনে চেষ্টা তদবিরে আনাগুনায় থাকে। অবশ্য প্রকল্প অনুমোদন কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ তা অস্বীকার করে বলেন নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকদের দিয়েই বাঁধে নির্মান কাজ করা হচ্ছে।
পাউবো ও কৃষকদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, সুনামগঞ্জে ছোট-বড় প্রায় ১৩৭টি হাওর রয়েছে। এই হাওরের বেড়িবাঁধের আয়তন প্রায় এক হাজার ৭১৮ কিলোমিটার। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রায় ১২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭২৭টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ৫৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মেরামত ও সংস্কার করা হয়।
চলতি বোরো মৌসুমে হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে পাউবো প্রাথমিকভাবে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পায়। গত অক্টোবর মাস থেকে তাদের ২৭টি দল (সার্ভেয়ার ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী) হাওরে গিয়ে সম্ভাবতা যাচাই করে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করে। এবছর প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর ফসল আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল থেকে রক্ষার জন্য ২০৫ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে হাওরের বাঁধ নির্মাণ কাজে। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি হতাশাজনক হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কৃষকরা। হাতে গুনা কয়েকটা ছাড়া প্রকল্পের কাজ চলছে অত্যন্ত ঢিমেতালে। কাজ শুরুই হয়নি অনেক প্রকল্পের। এতে নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ আগামী ফেব্রুয়ারির মাসের ২৮ তারিখের মধ্যে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নামার আগে বাঁধ নির্মাণ শেষ হবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন হাওর পাড়ের লাখো কৃষক।
স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ও পাউবো হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে গঠন করা হয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)। এসব হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ড কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এ বছর সুনামগঞ্জ জেলায় ১ হাজার ৮৯টি বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ২০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। এ পর্যন্ত বরাদ্দ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। আর অর্থ ছাড় হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
ফেব্রুয়ারির শেষ বা মধ্য মার্চে সুনামগঞ্জে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নামে। কিন্তু জানুয়ারির শেষ হলেও অধিকাংশ হাওরে কাজ শুরু হয়নি। আবার কিছু কিছু স্থানে পিআইসিও গঠন হয়নি। তাই কৃষকরা এবারো তাদের ফসল ঘরে তুলতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ১ হাজার ৮৯টি বাঁধের কাজ অনুমোদন হয়েছে। এর মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে বলে দাবি মাত্র প্রায় ৬শ টির মতো। তবে ‘বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি’- বলেছেন সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। কমিটি সময়মতো ও সুষ্ঠুভাবে বাঁধের কাজ সম্পন্নের জন্য গত সপ্তাহে সুনামগঞ্জ জেলা সদর ও বিভিন্ন উপজেলায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে হাওর বাঁচাও কমিটি।
জানা যায়, বাঁধ নির্মাণে প্রতিটি প্রকল্পের জন্য ৭ সদস্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করার নিয়ম। কমিটিতে সংশ্লিষ্ট হাওরের সুবিধাভোগী ৩ কৃষক, ১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রাথমিক অথবা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা অন্য কোনো শিক্ষক, স্থানীয় ইউপি সদস্য এবং একজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সদস্য করার নির্দেশনা রয়েছে। পিআইসি গঠন নিয়ে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ ওঠে। নেপথ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বাঁধ নিয়ে ব্যবসা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। আবার উপজেলা কমিটিতে সাংবাদিক প্রতিনিধি রাখার সময় কোন সাংবাদিকের মতামত না নিয়ে পছন্দের সাংবাদিক রাখায় ওই সাংবাদিক কোন তথ্য প্রদান করেননি। অতীতেও সাংবাদিক প্রতিনিধি সেজে শুধু কাবিটার মিটিং করায় অন্য সাংবাদিকরা ক্ষোব্ধতা প্রকাশ করেন।
জামালগঞ্জ উপজেলার পাকনা হাওরের ১৮টি বাঁধের মধ্যে মাত্র ৮ টিতে কাজ শুরু হয়েছে। হালির হাওরেও একই অবস্থা। উপজেলার ৫৯টি বাঁধের মধ্যে ৩০টির কাজও বাস্তবে শুরু হয়নি। বলে দাবী তুলেন হাওর বাঁচাও কমিটি। তবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিশ্বজিত দেব সকল পিআইসি সভাপতি সেক্রেটারীকে নিয়ে উপজেলা পরিষদ হলরুমে মিটিং করে শক্ত ভাবে সাফ জানিয়েছেন নীতিমালা অনুয়ায়ী হাওরের বাঁধ নির্মাণ কাজ করতে। এর ব্যর্তয় ঘটলে স্বস্ব পিআইসিকে এর দায় ভার নিতে হবে কোন ছাড় দেয়া হবেনা। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, ১ হাজার ৮৯টি হাওর রক্ষা বাঁধের প্রকল্প জেলা কমিটিতে অনুমোদন হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০০টি পিআইসি কাজ শুরু করেছে।
সুনামগঞ্জ জেলায় এবার ২ লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হচ্ছে। কোন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে সাড়ে ১৩ লাখ টন চাল কৃষকের গোলায় উঠার আশা করছেন সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ। তবে গত বছর বন্যায় সুনামগঞ্জে প্রায় ১২০ কোটি টাকার ফসল হানি হয়েছিল হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে।
‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’ সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নভেম্বর মাসের মধ্যে প্রকল্প নির্ধারণ ও পিআইসি গঠন করার কথা। কিন্তু জানুয়ারি শেষ তার পরেও অনেক বাধে কাজ শুরুই করেনি। হাওরের ফসলের কোন ক্ষয়ক্ষতি হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই দায় নিতে হবে।
সিলেট প্রতিদিন/ এমএনআই

বিজ্ঞাপন স্থান
পুরাতন সংবাদ খুঁজেন
বিজ্ঞাপন স্থান
ফেসবুক মন্তব্য