
সিলেটে ‘বহুরূপী’ তানিয়া

প্রতিদিন প্রতিবেদক
প্রকাশ ২০২২-০৯-১৪ ০৭:৪৩:৪৭

তানজিনা আক্তার তানিয়া।বয়স ২৫।গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়সিদ্দি। তবে তিনি থাকেন শাহজালাল উপশহরের এইচ ব্লকের একটি বাসায়। রূপের আড়ালে তিনি কৌশলে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষকে ফাঁদে ফেলেন। লুটে নেন কাড়িকাড়ি টাকা। কিছুদিন পূর্বে সিলেটে বান্ধবীর ভাইকে রক্ত দিতে গিয়ে দুই তরুণী গণধর্ষণের ঘটনা ছিল টক অব দ্যা টাউন। সেই ঘটনায় মামলা হওয়ার পর তানিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ ও ঘটনার দিন ওই এলাকায় তিনি যাননি বলে দাবি করেন। সিলেট প্রতিদিনকে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় তিনি একই কথা বলেছিলেন।কিন্তু সেই কথার আর ভিত্তি থাকলো না তার।নিজের মুখে নিজেই স্বীকার করলেন সে দিনের ঘটনা।
গত ৩০ আগস্ট রাতে সিলেট প্রতিদিনকে তানিয়া জানান, এ ধর্ষণকাণ্ডের ঘটনায় তিনি কোনভাবেই জড়িত নন।তাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে।রক্তদানের কথা বলে আমি নাকি অভিযোগকারী ওই দুই তরুণীকে হোটেলে নিয়ে গিয়েছি, যা ডাহা মিথ্যা। বর্তমান সময়ে চারদিকে সিসি ক্যামেরা সক্রিয়।
কোথাও কোন সিসি ফুটেজে আমার সম্পৃক্ততা কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।এইদিন আমি এই এলাকায় যাইনি সুতরাং এই ঘটনায় আমাকে কেন জড়ানো হয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়।
এসময় তিনি দাবী করেন তাকে ফাসানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে একটি চক্র কাজ করছে।এই ঘটনায় তিনি পুলিশ ও সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করেন।যাতে প্রকৃত ঘটনা আড়াল না পড়ে যায়।
তিনি এসময় সিলেট প্রতিদিনকে আরও জানান, আইনের মাধ্যমে ঘটনা মোকাবিলা করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করবেন।
এবার দেখা যাক সেইদিনের কথার সাথে তানিয়ার কতটা মিল রয়েছে সম্প্রতি সিলেট প্রতিদিনের কাছে আসা ১ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপে।
ভিডিওতে তানিয়া বলেন, ‘মানুষ অনেক কিছু জানে না।অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। এই মামলা সম্পর্কে। আর ঘটনাটি যে জায়গা হয়েছে ই জায়গা শিপলুর আন্ডারে (দখলে) ছিল।টোটালি তার আন্ডারে ছিল।পুলিশে বোঝতে পারবো ই জায়গা কে থাকে। মানুষকে জিজ্ঞেস করলে বোঝা যাবে এখানে কে থাকে। তার ক্ষমতা ইউজ (ব্যবহার) করে।’
‘ই দিন(ঘটনার দিন) আমাকে বলে যাওয়ার জন্য।তখন আমি তার কথায় যাই।যাওয়া পর আমাকে আটকে ফেলে। আটকে বলে তুই জুবলেকে আনা।তখন আমি বাঁচার জন্য জুবেলকে ফোন দেই।তা না হলে আমাকে মেরে ফেলবে।পরে আমি শিপলুকে বলি ভাই আমাকে ছেড়ে দিন।।জুবেলকে আনানোর পর আমাকে দুইটা মেয়ের পিকচার দেখায়।যাদের সাথে অনৈতিক কাজ করে মানে যারা ধর্ষণের অভিযোগ করেছে।তাদের সাথে শিপলুর সম্ভবত পূর্বে কোনো সমস্যা হয়েছিল।তা আমি জানিনা। পরে আমি তাদেরকে কল করি।কল করে বলি আপ্পি আপনি আসবেন কি এত টাকা? এসব বলে তাদেরকে আনানো হয়।এনে তাদেরকে রাতভর নির্যাতন করে সে (শিপলু)। আমাকেও নির্যাতন করেছে।সারারাত বসিয়ে রাখে আমাকে।সারারাতের মধ্যে আমাকে আসতে দেয়নি।’
তানিয়ার দুই দিনের দুই কথাবার্তায় ঘটনা মোড় নিচ্ছে অন্যদিকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নজন বলছেন আসলেও কি সেদিন রক্তদানের জন্য গিয়েছিল ওই দুই তরুনী।নাকি অন্যকিছু।
সূত্র বলছে, মূলত টাকার বিনিময়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে যাওয়া আসা করে থাকেন তানিয়া।সেইদিনও তিনি ওই হোটেলে গিয়েছিলেন। পরে টাকার বিনিময়ে ওই দুজনেকে হোটেলে ডাকেন।ওইদিন সকাল বেলা এক সাথে তিন তরুণী হোটেল থেকে সিএনজি নিয়ে বাসায় ফিরেন।
সূত্র আরও বলছে, তানিয়ার সাথে সিলেট নগরের আরও একটি সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে। তারা অনেক ধন্যাট্য পরিবারের ছেলেদেরকে তাদের পাতানো ফাঁদে ফেলেছে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টিকটকের মাধ্যমে তাদের সাথে বন্ধত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে।একটা সময় ওই পরিবারের ছেলেদেরকে টার্গেট করে তার উদ্দেশ্য হাসিল করে।সিলেটে প্রতিদেনর কাছে এক পাথর ব্যবসায়ীর তথ্য -উপাত্ত রয়েছে যিনি তানিয়ার ফাঁদে পা দিয়ে খুইয়েছেন সর্বস্ব।
এদিকে,এই ঘটনায় তানজিনা আক্তার তানিয়াকে (২৫) মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর শিবগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৯। পরবর্তীতে আজ সকালে তাকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের জালালাবাদ থানায় হস্তান্তর করেছে র্যাব।
বুধবার (১৪ সেপ্টেম্বর) বিষয়টি সিলেট প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছেন জালালাবাদ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খালেদ মামুন।
গ্রেফতারকৃত তানিয়া দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার জয়সিদ্দি গ্রামের দবির মিয়ার মেয়ে।
পুলিশ কর্মকর্তা খালেদ মামুন জানান, আসামীকে আজ আদালতে তোলা হলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এই মামলার আরেক আসামি মােহাইমিন রহমান রাহি (৩৩)-কে গত ২ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। পরে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। রাহি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার নগর গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে।
উল্লেখ্য, ২৩ আগস্ট দিবাগত রাতে মহানগরীর পাঠানটুলাস্থ জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী গ্রিন হিল আবাসিক হোটেলের দুটি কক্ষে দুই তরুণীকে আটকে রেখে রাতভর পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। এ ঘটনায় ভিকটিম দুই তরুণী সিলেটের জালালাবাদ থানায় পৃথক মামলা দায়ের করেন।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার এক তরুণী (১৮) কয়েক মাস আগে আইএলটিএস পড়ার জন্য সিলেট মহানগরীতে এসে আরেক নাট্যশিল্পী তরুণী (২৫)-এর সঙ্গে শাহজালাল উপশহরের একটি বাসায় থাকতে শুরু করেন। উপশহর এলাকায় থাকার সুবাধে ওই এলাকার একটি বিউটি পার্লারের গিয়ে তানজিনা আক্তার তানিয়া (২৫) নামের এক তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তানিয়া সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়সিদ্দি গ্রামের দবির মিয়ার মেয়ে। তিনি শাহজালাল উপশহরের এইচ ব্লকের ৪ নং রোডের আলী ভিলা নামক ৫ তলা বাসায় ভাড়াটে থাকেন।
পরিচয়ের এক পর্যায়ে তানিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে সিলেটে আইএলটিএস করতে আসা সেই তরুণীর। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সুবাধে গত ২৩ আগস্ট রাত সাড়ে ৮টার দিকে তানিয়া ফোন করে ওই তরুণীকে বলেন- তার ভাইয়ের জন্য এবি পজেটিভ রক্ত প্রয়োজন। ওই তরুণীর এবি পজেটিভ রক্ত হওয়ায় তিনি যেন এক ব্যাগ রক্ত দেওয়ার জন্য রাগীব-রাবেয়া হাসপাতালে যান। এমন ফোন পেয়ে ওই তরুণী তার বন্ধবীকে (২৫) নিয়ে তৎক্ষণাৎ রাগীব-রাবেয়া হাসপাতালের সামনে যান। সেখানে গিয়ে তানিয়াকে দেখতে পেয়ে রক্ত দেওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি ওই দুই তরুণীকে জানান- রক্ত দেওয়ার আগে তার এক কাজিনের বাসায় একটু প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন শেষ করে তারা হাসপাতালে যাবেন। এ কথা বলে কৌশলে ওই দুই তরুণীকে জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী গ্রিন হিল আবাসিক হোটেলের ৪র্থ তলায় নিয়ে যান তানিয়া এবং তাদের দুজনকে আলাদা আলাদা কক্ষে বসিয়ে রাখেন। এসময় তানিয়ার সহযোগী কয়েকজন তরুণ ও যুবক এসে ওই দুই তরুণীকে আটকে রাখেন এবং রাত সাড়ে ১১টার থেকে একের পর এক ১০-১২ জন যুবক তাদের দুজনকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন। এছাড়াও ভিকটিম এক তরুণীর (১৮) কাছ থেকে তার মোবাইল ফোন ও নগদ টাকা পয়সা জোরপূর্বক নিয়ে যান তানিয়া ও ধর্ষকরা। পরদিন (২৪ আগস্ট) দুপুর ১টার দিকে ভিকটিম দুই তরুণীকে এক কক্ষে নিয়ে তাদের কাছ থেকে ‘ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি’ এ মর্মে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয় এবং এ কথাগুলো মোবাইল ফোনে ভিডিও করে তাদের ছেড়ে দেন তানিয়া ও তার সহযোগিরা।
ঘটনার পর দুই ভিকটিম তরুণী জালালাবাদ থানায় পৃথক মামলা দায়ের করেন। তানিয়া ছাড়াও এই দুই মামলার আসমিরা হলেন- সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার নগর গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে মোহাইমিন রহমান রাহি (৩৩), সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক থানার গোবিগন্দগঞ্জ গ্রামের মৃত তহুর আলীর ছেলে জুবেল (৩১), সিলেট নগরীর পাঠানটুলা এলাকার আলী আকবরের ছেলে রানা আহমদ শিপলু ওরফে শিবলু (৩৫), সুনামগঞ্জ সদর থানার হরিনাপাট গ্রামের ফরহাদ রাজা চৌধুরীর ছেলে নাবিল রাজা চৌধুরী (৩৫) ও সুজন (৩৫) এবং অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জন।
তবে এ মামলার আসামি রানা আহমদ শিপলুর স্ত্রী গত ৫ সেপ্টেম্বর সিলেট জেলা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন- তার স্বামী সম্পূর্ণ নির্দোষ, তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসানো হয়েছে।
সিলেট প্রতিদিন/ এমএ

বিজ্ঞাপন স্থান
পুরাতন সংবাদ খুঁজেন
বিজ্ঞাপন স্থান
ফেসবুক মন্তব্য